সূর্য্য (bsurjo03@gmail.com)
বলা হয় যে ভারতের থেকে নাকি আমেরিকায় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা অনেক উন্নত | শুধু তাই নয়, আমেরিকাতে নাকি কাস্টমারদের অনেক বেশি খাতির যত্ন করা হয় | ছোটবেলা থেকে বহুবার ভারত এ ব্যাঙ্ক এ গেছি. সবসময়ে দেখতাম প্রচুর ভীড়, প্রচুর লম্বা লাইন দিয়ে লোকজন কে অপেক্ষা করতে হয় | ব্যাঙ্ক এর কর্মচারীরা কাজের চাপ এ ব্যতিব্যস্ত, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা কাস্টমারদের কাজ করে দিচ্ছেন | আমেরিকার ব্যাঙ্ক অন্যরকম | এখানে প্রচুর ব্যাঙ্ক এর ব্রাঞ্চ, তাই কোনো ব্যাংকেই খুব ভিড় নেই | ভিড় বা কাজ এর চাপ কম, তাই এখানকার ব্যাঙ্ক এর কর্মচারীরাও খুব হাসিখুশি | সমস্ত কাস্টমার এর সঙ্গেই এমন ভাবে গপ্পো জুড়ে দেন যেন কতদিনের ঘনিষ্ট বনধু | কিনতু তার মানে এই নয় যে এখানকার ব্যাংকে কখনো "আজ হবে না, পরে আসুন" জাতীয় কথা শুনতে হয় না | এই দেশেও যেকোনো জটিল পরিস্থিতী ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্ক অফিসারদের সমস্যাতে ফেলে দেয় | আমার একটি অভিনব অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে তুলে ধরছি |
বেশ
কিছু বছর আগেকার কথা | নতুন শতাব্দী শুরু হয়ে গেছে, আই টি (তথ্য প্রযুক্তি ) ইন্ডাস্ট্রি র কল্যানে প্রচুর
ভারতীয় দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে | কিনতু তখন শুধুমাত্র মানুষ স্মার্ট ছিল , তাদের মোবাইলগুলো তখনও স্মার্ট হয়ে ওঠেনি | তখন মোবাইল থেকে শুধু কল বা SMS করা যেত | হয়তো কোনো কোনো মোবাইল এ গেমস আর ক্যামেরা
থাকতো | কিনতু কারো ফোনেই তখন ব্যাঙ্ক এর "এপ" (APP ) থাকতো না | |
চেক জমা করার জন্যও তখন
ব্যাঙ্ক এ যেতে হতো,
মোবাইল এ ছবি তুলে
নিয়ে কার্যসিদ্ধি করা যেত না | আমার এক বনধু অভীক সস্ত্রীক আমেরিকা এসেছিলো ৮ মাসের একটা
কাজ নিয়ে | পাঠক পাঠিকাগন অবগত থাকবেন, আমেরিকায় এসে বাড়ি ভাড়া নিতে হলে ১ বা ২
মাসের বাড়ি ভাড়া ডিপোজিট রাখতে হয় , যদি না ভালো " রেন্টার হিস্ট্রি " থাকে
| অভীককেও এই ডিপোজিট রাখতে হয়েছিল | কলকাতা ফিরে যাওয়ার সময়ে অভীক আমায় দায়িত্ত্ব দিয়ে গেছিলো যে ওর বাড়িওয়ালা ওকে ডিপোজিট থেকে যা টাকা ফেরত দেবে সেটা যেন আমি ওর ব্যাঙ্ক এ জমা করে
দেই | আমিও এই গুরু দায়িত্ত্ব পালন করার জন্য একদিন সকাল এ হাজির হলাম
ব্যাঙ্ক এ
|
কাউন্টার
এর মহিলা সদর অব্যর্থনা জানালেন | এও জানালেন যে আমি আসায় উনি ভীষণ খুশি হয়েছেন | জানতে চাইলেন যে গত শনি-রবিবার আমি কি করেছি | আমি দুঃখের সঙ্গে জানালাম যে আমি এই দেশ এ নতুন, বিশেষ
কিছু করার সুযোগ হয়নি | উনি কি করেছেন সেই ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করায় মহিলা জানালেন যে শনি-রবিবার ওনারা কোথাও একটা মাছ ধরে কাটিয়েছেন | আমি খুব উৎসাহের সঙ্গে জানালাম যে মাছ এর ব্যাপারে আমার খুব উৎসাহ আছে | মহিলা কৌতূহল প্রকাশ করায় আমি সগর্বে জানালাম যে মাছ ভাত খেয়ে ছুটির দুপুরে ঘুম দিতে দারুন লাগে | উনি কখনও মাছ খেয়ে দিবানিদ্রা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলাম | মহিলা খুব গম্ভীর হয়ে জানালেন যে ওনার পুত্র যখন ৪ বছর বয়েসী ছিল তখন দিবানিদ্রা দিতো | এখন ওনাদের বাড়িতে কেউ দিবানিদ্রা দেয় না | হতাশ কণ্ঠে ঈশ্বর কে স্মরণ করে মহিলা বললেন যে এই দেশ এ দুপুরটা ঘুমিয়ে
কাটিয়ে দিলে তো শনি-রবিবার প্রায় বেশিরভাগ শেষ হয়ে যায় | এরপরে উইকেন্ড উপভোগ করার সুযোগ আর কিছুই থাকে না | আমিও মনে মনে বললাম "হে ঈশ্বর , এই বার্গার -পিজা ভক্ষণকারী মহিলা কে ক্ষমা করো, এরা ছুটির দুপুরে মাছ ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা উপভোগ করার মর্মই জানে না" | যাই হোক, শেষ অবধি মহিলা আমার ব্যাঙ্ক এ আসার কারণ জানতে চাইলেন | আমিও
অকপটে জানালাম যে আমার বন্ধুর একাউন্ট এ চেক জমা দিতে এসেছি | খুব
আশ্চর্য্য হলাম মহিলার জবাব শুনে | আমায় নাকি অভীক এর লিখিত অনুমতি দেখাতে হবে এই জন্য | আমি বললাম যে আমি তো টাকা তুলছি না, জমা দিচ্ছি , তাহলে এতো সমস্যা কিসের ? মহিলা জানালেন যে আমার বনধু অভীকের যদি একাধিক একাউন্ট
থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা থেকে যায় যে ও হয়তো অন্য কোনো একাউন্ট এ টাকা জমা
দিতে চায় | হাজার হোক, এই ৬৪০ ডলার খুব কম টাকা নয় | এই টাকা তে নাকি ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে আসা যায় | সুতরাং ওনাকে সাবধানী হতেই হবে | কি আর করা, আমি বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম |
কয়েকদিন
পরেই আবার ব্যাঙ্ক এ হাজির হলাম
| ইতিমধ্যে অভীক আমাকে ইমেইল করে লিখিত ভাবে জানিয়েছে যে ওই ৬৪০ ডলার এর চেক যেন আমি ওর ওই একাউন্ট এই জমা করি | রীতিমতো গুরুগম্ভীর ভাষায় ইমেইল, অভীক এর নাম ঠিকানা, একাউন্ট নম্বর সব কিছু দিয়ে লেখা | এবার চেক জমা নিতেই হবে | কাউন্টার এ এইবার এক
নতুন ভদ্রলোক কে দেখলাম | তিনি শনি রবিবার এর আবহাওয়া, বৃষ্টি-রোদ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করার পরে কাজের কথায় এলেন | আমি আগের দিন এর অভিজ্ঞতা জানালাম, সঙ্গে আমার বন্ধুর ইমেইল এর প্রিন্ট আউট দেখালাম | ভদ্রলোক খুবই দুঃখিত কণ্ঠে জানালেন যে ইমেইল
এর প্রিন্ট আউট গ্রাহ্য হয় না, অভীক যদি এই বক্তব্যটি কাগজ এ লিখে সই
করে পাঠায়, তাহলেই হবে | এও জানালেন যে এতো কিছুই হতো না যদি অভীক নিজেই এসে চেক টা জমা করতেন | আমি জানালাম যে অভীকের ও ভীষণ
ইচ্ছে ছিল ব্যাঙ্ক এ এসেই চেক
টা জমা করা কিনতু ও এখানে নেই
বলেই আমাকে আসতে হয়েছে | ভদ্রলোক গর্বের সঙ্গে জানালেন যে ওনাদের ব্যাঙ্ক এর ব্রাঞ্চ
আমেরিকার সমস্ত শহরেই আছে | এই সমস্যা কোনো সমস্যা নয় | আমি একটু বিব্রত কণ্ঠেই জানালাম যে তবুও সামান্য সমস্যা থেকেই যাচ্ছে, কারণ অভীক আমেরিকার অন্য শহরে নেই, ও কলকাতায় আছে
| ভদ্রলোক এবারে মনে হয় বুঝলেন সমস্যাটা | দেখি কি করা যায় বলে উনি কিছুক্ষন ওনার কম্পিউটার এ কিছু খুঁজলেন
| তারপরে ভেতরে ওনার ম্যানেজার এর সঙ্গে কথা বলতে চলে গেলেন | মিনিট পনেরো পরে উনি ফিরে এসে জানালেন যে উনি চেষ্টা করেছেন, এবং খুঁজে না পেয়ে ওনার ম্যানেজার এর সঙ্গেও পরামর্শ করেছেন | কিনতু শেষ পর্যন্ত্য দুজনেই এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে কলকাতায় ওনাদের ব্যাঙ্ক এর কোনো ব্রাঞ্চ নেই | তাই একমাত্র উপায় অভীক এর সই করা এপ্লিকেশন | কি আর করা, আবার বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম |
এর
পরে সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেছে | অভীক আমাকে সই করা এপ্লিকেশন ও পাঠিয়ে দিয়েছে | সেই
এপ্লিকেশন নিয়ে আবার হাজির হলাম ব্যাঙ্ক এ | এইবারে আবার সেই প্রথম দিন এর মহিলার সঙ্গে দেখা হলো | গর্বের সঙ্গে জানালাম যেই এই শনি রবিবার একেবারেই ঘুমাইনি | ৫ টা সিনেমা
দেখে ফেলেছি | মহিলাও দেখলাম খুব খুশি আমার এই পরিবর্তন এ | আগের দিন এর আলোচনা ওনাকে মনে করিয়ে দিলাম, তারপরে এপ্লিকেশন ও দিলাম | মহিলাও
দেখলাম বললেন যে সব কাগজ ঠিক থাকে আছে | ৩ সপ্তাহ ধরে
চেষ্টা করে অবশেষে চেক টা জমা করতে পারবো, এই আনন্দে আমি ভাসছি, হঠাৎ মহিলার একটি প্রশ্নে আমায় ভাসমান অবস্থা থেকে মাটিতে নেমে আসতে হলো | একাউন্ট আর চেক এর নাম নাকি মিলছে না | কি করে এটা হলো? একাউন্ট এ নাম আছে
"অভীক কুমার চ্যাটার্জী" আর এদিক এ চেক ইসু
করা হয়েছে "অভীক কুমার চ্যাটার্জী এন্ড সুমিতা চ্যাটার্জী " নাম এ | এতে চিন্তার কি আছে তো বুঝলাম না, বাড়ি ভাড়া নেয়ার সময়ে অভীক আর ওর স্ত্রী সুমিতা, দুজনেই লিজ এ সই করেছিল,
তাই বাড়িওয়ালা দুজনের নাম এ টাকা রিফান্ড
করেছে | এটা শুনেই মহিলা ভীষণ
উত্তেজিত হয়ে পড়লেন | এটা নাকি একেবারে অন্যায় কাজ | দুজনের নামে যে চেক এসেছে, সেটা
একজন এর একাউন্ট এ জমা করা খুব অন্যায় | উনি আমায় পরামর্শ দিলেন যে দুজনের জয়েন্ট ব্যাঙ্ক
একাউন্ট এ চেক টা জমা করতে | আমি জানালাম যে আমার বনধু খুব অল্পদিন এর জন্যই এই দেশ
এ এসেছিলো, আর ওর স্ত্রী সুমিতা চাকরি ও করতো না, তাই আর জয়েন্ট একাউন্ট খোলা হয়ে ওঠেনি
| সুমিতার যে কোনো ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই, এই দারিদ্র্য মনে মনে কল্পনা করে মহিলা খুব হতাশ হয়ে পড়লেন |
কিছুক্ষন পরে উনি খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন যখন আমার থেকে জানতে পারলেন, যে কলকাতায় সুমিতার একাধিক ব্যাঙ্ক একাউন্ট, ফিক্সড ডিপোজিট
এবং জয়েন্ট একাউন্টও আছে | কিনতু একটু পরেই আবার
উনি হতাশায় ডুবে গেলেন, কারণ কলকাতার
সেই জয়েন্ট একাউন্ট গুলোয় ডলার জমা করা যাবে না, চেক টা এই ব্যাঙ্ক এই জমা করতে হবে
| শেষমেশ উনি বললেন যে দুজনের নামের চেক শুধু মাত্র অভীক এর একাউন্ট এ জমা করতে সুমিতার
লিখিত অনুমতি লাগবে | সেটা আমি নিয়ে এলেই উনি চেকটা জমা করে ফেলবেন | বার বার আমায়
ফিরিয়ে দিতে ওনার খুবই দুঃখ হচ্ছে, কিনতু উনি নিরুপায় - হাজার হোক, এই ৬৪০ ডলার খুব
কম টাকা নয় | এই টাকা তে যে ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে আসা যায় সেটা আবার মনে করিয়ে
দিয়ে উনি বোঝালেন যে ওনাকে সাবধানী হতেই হবে | যথারীতি আমি আবার বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে
এলাম |
এই
খবর যখন কলকাতায় পৌছালো, তখন অভীক অফিসের কাজ এ ২-৩
মাসের জন্য ইংল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলো, আর সুমিতা তখন কলকাতার বাইরে কোনো আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে গেছে | আমি ওদের কে বোঝালাম, ৬৪০ ডলার খুব কম টাকা নয় | এই টাকাতে যে ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে আসা যায় , তাই ওরা যেন আর গাফিলতি না করে সমস্ত কাগজপত্র আমায় পাঠিয়ে দেয় | এই বোঝানোর ফলস্বরূপ অভীকের ইংল্যান্ড
যাওয়া ২ সপ্তাহ পিছিয়ে
গেলো, সুমিতার কলকাতায় ফেরার দিন ও ১ সপ্তাহ
এগিয়ে এলো | এবং কিছুদিন পরেই আবার এক সুন্দর সকাল এ আমি ব্যাঙ্ক
এ গিয়ে হাজির হলাম |
এবারে
আবার সেই ভদ্রলোক এর সঙ্গে কথা হলো | যথারীতি সমস্ত রকম কুশল বার্তা ও অভিবাদন বিনিময়ের
পরে আমি সেই চেক আর সমস্ত রকম এর লিখিত অনুমতির কাগজপত্র ওনাকে দেখালাম | আগের দিন মহিলার সঙ্গে কি কি আলোচনা হয়েছিল সেটাও বললাম | ভদ্রলোক কাগজপত্র দেখে একটু গম্ভীর হলেন | চিন্তিত মুখে আবার উনি কিছু একটা আলোচনা করতে চলে গেলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার এর সঙ্গে | আমিও মনে মনে তৈরী হওয়া শুরু করলাম নতুন কিছু নিয়ম শোনার জন্য | ভদ্রলোক এবারে এসে বললেন যে প্রায় সব ঠিকঠাক আছে , শুধু সুমিতার এপ্লিকেশন টা একটু গোলমেলে | এমনি কাগজ এ সই করে
দিয়েছে ঠিকই , কিনতু এটা কোনো নোটারি অফিসার এর সামনে করলে উনি নিশ্চিন্ত হতে পারতেন | ভদ্রলোকের নিশ্চিন্ত
না হতে পারায় আমারও চিন্তা বেড়ে গেলো | আমি ওনাকে মনে করালাম যে কিছু সপ্তাহ আগেও একবার উনি ইমেইল এর প্রিন্ট আউট দেখে চিন্তায় পরে গেছিলেন, কিনতু তারপরে আমি অভীক এর সই করা এপ্লিকেশন নিয়ে পাশের কাউন্টার এ এসেছিলাম | সেটা
নোটারি অফিসার এর সামনে করা হয়নি দেখেও কিনতু পাশের কাউন্টার এর মহিলা যথেষ্টই নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলেন | ভদ্রলোক
কে অনুরোধ করলাম পাশের কাউন্টার এর মহিলাকে দেখিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হতে | এইসব শুনে পাশের কাউন্টার এর মহিলাও এসে হাজির হলেন | আমি একগাল হেসে ওনাকে বললাম যে আমি শনি রবিবার দুপুরে ঘুমানো বন্ধ করে দিয়েছি | এও বললাম যে এই চেক নিয়ে অভীক এর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য বেশিরভাগ রাতেও ঘুমানো বন্ধ করে দিয়েছি | ভেবেছিলাম খুশি হবেন, কিনতু মহিলা গম্ভীর হয়ে গেলেন | অবশেষে
সই নিয়ে আলোচনা করে উনি আর এই ভদ্রলোক যা বললেন , তার সারমর্ম খুব জটিল | অভীক এই ব্যাঙ্ক এর কাস্টমার, ওর সই ব্যাঙ্ক এর রেকর্ড এ আছে |
এছাড়া অভীকের একাউন্ট
এই অভীকের চেক জমা হচ্ছে | তাই অভীকের ক্ষেত্রে সাধারণ সই
দেখেই ওনারা নিশ্চিন্ত হতে পারেন | সুমিতা একে তো ব্যাঙ্ক এর কাস্টমার নয়, তার ওপরে ওর নাম এর চেক অন্য একজন এর নাম এ জমা হচ্ছে,
তাই ওর এই সই টা নোটারি অফিসার এর সামনে না করলে ব্যাঙ্ক এর অফিসার রা ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না | মহিলা আরো একবার মন্তব্য করলেন, এই ৬৪০ ডলার খুব কম টাকা নয় | এই টাকাতে যে ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে আসা যায় সেটাও আবার মনে করিয়ে দিলেন | তাই ওনাদের একটু সাবধানী হতেই হয় | আমি শেষ চেষ্টা করার জন্য বললাম যে অভীক আর সুমিতা ইংল্যান্ড যাচ্ছে, একটু যদি সেটা বিবেচনা করে ওনারা চেক টা জমা করে নেন, তাহলে আর ইংল্যান্ড এর মাটিতে নেমে ওদের নোটারি অফিসার খুঁজে বেড়াতে হবে না| ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন এটা কোনো সমস্যাই নয় | ইংল্যান্ড এর ভারতীয় দূতাবাস এ গেলেই ওরা
নোটারি করতে পারবে | ভদ্রমহিলা আরো একটা উপায় বললেন, ইংল্যান্ড অবধি তো এসেই গেছে, আরেকটু এগোলেই আমেরিকা | এখানে এসে দুজনে মিলে চেকটা জমা করে যেতে পারে | ভদ্রলোকও বললেন যে এটা খুব ভালো প্রস্তাব | এতদিন ধরে অভীক আর সুমিতার নাম শুনে ওনাদেরও খুব উৎসাহ যে কবে এদের দেখা পাবে | ওনারা খুবই খুশি হবেন যদি অভীক আর সুমিতাকে ব্যক্তিগত ভাবে এই ব্যাঙ্ক এ অভ্যর্থনা জানাতে
পারেন | বুঝলাম এদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা | আবার আমি বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম |
অভীক
কে ফোন করলাম আবার | অভীক তখন ইংল্যান্ড এ যাওয়ার জন্য
ব্যাগ গোছাচ্ছে | অফিসার দের দেয়া দুটো উপায় ও বুঝিয়ে বললাম
| এতো দুটো সহজ উপায় জানিনা কেন ওর খুব কঠিন মনে হলো, এবং উত্তেজিত হয়ে চেঁচামিচি শুরু করে দিলো | অভীক এর বক্তব্য, আরো সহজ দুটো উপায় আছে | এক, ওই চেকটা আমি কুচি কুচি করে ছিড়ে ওই ব্যাঙ্ক অফিসারদের চরণে সমর্পন করি | দুই, ওই চেক টা আমি যেন ব্যাঙ্ক অফিসার দের..... না থাক সে কথা , রাগের মাথায় কি না কি বলেছিলো অভীক, সেকথা আর নাই বা বললাম | বনধু হিসেবে আমার কর্তব্য ছিল ওকে ঠান্ডা করা | তাই বললাম মাথা গরম না করতে |ব্যাঙ্ক অফিসার দের কাজ সাবধানী হওয়া, ওরা তাই করছে | ব্যাঙ্ক অফিসার দের কর্তব্যপরায়ণতা দেখে অভীক আবেগে আপ্লুত হয়ে "সুমধুর ভাষণে " আরো কিছু বক্তব্য রাখলো | শুধু তাই নয়, ওদের দুজনের নাম এ চেক লেখার
জন্য বাড়ির মালিক কেও প্রচুর আবেগপূর্ণ "সুমধুর" সম্ভাষণ এ ভূষিত করলো
| অভীক আবেগ এ ভেসে যাচ্ছে
দেখে ওকে আবার মনে করালাম যে এই ৬৪০ ডলার খুব কম টাকা নয় | এই টাকা তে যে ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে আসা যায় | অভীক "সুমধুর" সম্ভাষণ এ আমায় বোঝালো আমি যেন ওই ব্যাঙ্ক অফিসারদের, এবং তাদের মাতাপিতা ইত্যাদিকে ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে আসতে অনুরোধ করি | এটাই অভীক এর শেষ ইচ্ছা ওই ৬৪০ ডলার এর ব্যাপারে | কি আর করা, ফোন রেখে দিলাম |
দিন
দুয়েক কেটে গেছে | এক শুক্রবার দুপুরে অফিস থেকে হ্যাপি আওয়ার এ গিয়েছি , এবং অভীক এর চেক এর পরিনাম এর কথা ভেবে খুব একটা হ্যাপি হতে পারছি না | জানলা দিয়ে দেখলাম, সেই ব্যাঙ্ক এর অন্য একটা ব্রাঞ্চ আছে এই গলিতে | হঠাৎ একটা নতুন আইডিয়া এলো , এবং আমি শেষ চেষ্টা করার জন্য ব্যাঙ্ক এ হাজির হলাম
| সেই ব্যাঙ্ক, কিনতু অন্য ব্রাঞ্চ | ব্রাঞ্চ আলাদা হলেও সব ব্যাঙ্ক এর অফিসাররা একই রকম ভদ্র এবং কাস্টমার বৎসল হন | এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না | কাউন্টার এর মহিলা অভিবাদন করে কুশল সংবাদ নিলেন | তারপরে
জানতে চাইলেন যে শনি রবিবার আমার কি পরিকল্পনা আছে | আমি সগর্বে ঘোষণা করলাম
যে আমি সারা দুপুর মাছ ধরবো , সারা সন্ধ্যে ভাজবো, আর রাতে সেই মাছ ভাজা খাবো | মহিলা খুব উৎসাহী কণ্ঠে জানালেন যে এইরকম পরিকল্পনা ওনার ও আছে, কিনতু
বর্তমান এ ১ বছর
বয়েসী শিশু কন্যা দিবানিদ্রা দেন বলে ওনারা দুপুরে বাড়িতে ত্থাকেন | আমি সহানুভূতির সূরে বললাম যে শিগগিরই ওনার কন্যা বড় হবে এবং ওনারা দিবানিদ্রা থেকে বেঁচে যাবেন | দুপুরটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে তো শনি-রবিবার প্রায় বেশিরভাগ শেষ হয়ে যায় সেকথাও করুনার সূরে বলতে ছাড়লাম না |
মহিলা
হয়তো আন্দাজ করলেন যে ভারতীয় হলেও আমি এই দেশের আদবকায়দায় ওয়াকিবহাল | উনি সপ্রশংস দৃষ্টি নিয়ে এবারে আমার ব্যাঙ্ক এ আসার কারণ
জানতে চাইলাম | আমি ঘোষণা করলাম যে আমি চেক জমা দিতে এসেছি নিজের একাউন্ট এ | উনি আমায় অনুরোধ করলেন ডেবিট কার্ড সোয়াইপ করতে | আমি দুঃখিত হয়ে জানালাম যে আমি ডেবিট কার্ড আনতে ভুলে গেছি, শুনে মহিলাও খুবই দুঃখিত হলেন দেখলাম | কিনতু আমি একাউন্ট নম্বর টা মনে রেখেছি শুনে আবার আনন্দিত হয়ে উঠলেন | ভারতীয়দের স্মরণশক্তির প্রশংসাও করলেন | আমিও গর্বিত হয়ে জানালাম যে আমরা ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ছাড়া পরীক্ষা দিয়ে থাকি, সেইজন্য আমাদের মাথাটা একটু সজাগ থাকে | মহিলা ইতিমধ্যে একাউন্ট নম্বর দিয়ে অভীক এর একাউন্টটা লোকেট করে ফেলেছেন | আমায় বললেন নাম আর ঠিকানা বলতে যাতে উনি মিলিয়ে দেখতে পারেন | আমি গম্ভীর ভাবে ঘোষণা করলাম যে আমার নাম "অভীক কুমার চ্যাটার্জী এন্ড সুমিতা চ্যাটার্জী " | উনি একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তে তাকিয়ে আছেন দেখে ওনাকে প্রশ্ন করলাম যে ভারতীয়দের নাম যে খুব বড় হয় সেটা নিশ্চই ওনার অজানা নয় | উনি জানালেন যে সেটা উনিও জানেন, কিনতু একটা নাম এ দুটো "চ্যাটার্জী
" দেখে একটু অবাক হয়েছেন | আমি বললাম যে অনেক ভারতীয়দের নাম এই রকম হয় | আমার এক সহকর্মীর নাম "সুন্দরমূর্তি রামমূর্তি" | আমার কাছে তার ভিসিটিং কার্ড ছিল , সেটা উদাহরণস্বরূপ দেখিয়ে দিলাম | বললাম যে এর নামে যেমন দুটো "মূর্তি" আমার সেরকম দুটো "চ্যাটার্জী" | মহিলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে স্বীকার করলেন যে ভারতীয়দের মেধা আর ভারতীয়দের নামের দৈর্ঘ, এগুলো দেখে বারংবার ওনাদের অবাক হতে হয় |
আমি মন্তব্য করলাম যে মেধা টা সমস্যা নয়, কিনতু দৈর্ঘ টা অনেক সময় একটু সমস্যা হয় | যেমন ব্যাঙ্ক এ একাউন্ট খোলার
সময়ে পুরো নামটা লেখার
জায়গা থাকে না | মহিলা খুব উৎসাহিত হয়ে বললেন যে ওটা উনিও লক্ষ্য করেছেন, ব্যাঙ্ক এর খাতায় আমার নাম "অভীক কুমার চ্যাটার্জী এন্ড সুমিতা চ্যাটার্জী " থেকে ছোট করে শুধু "অভীক
কুমার চ্যাটার্জী " করা আছে | আমি দেখলাম যে সবকিছু ভালোই এগোচ্ছে | আমি এই সুযোগে অভীক আর সুমিতার নাম লেখা চেকটা মহিলাকে দিয়ে বললাম চেকটা জমা করে দিতে | চেকে যে পুরো
"অভীক কুমার চ্যাটার্জী এন্ড সুমিতা চ্যাটার্জী " নামটা লেখা আছে দেখে উনিও খুব খুশি | উনি আমায় আশ্বাস দিলেন যে ভবিষ্যতে ব্যাঙ্ক এর খাতায় ও যাতে বড়
বড় নামগুলো লেখা যায়, উনি ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষ কে সেই ব্যব্যস্থা করতে অনুরোধ করবেন | আমি ওনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানালাম এবং অনুরোধ করলাম আজকের মতো শুধু চেকটা জমা করে দেয়ার জন্য | মহিলা হঠাৎ চেক এর দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন | আমি ভাবলাম যে আবার হয়তো কোনো বিপদ এ পড়তে চলেছি
| মহিলা জানালেন যে চেকটা আমেরিকার অন্য রাজ্যের অন্য শহর এ ইসু করা,
আমার ঠিকানা ও সেই অন্য
শহরের | এতো দূরে আমি এই শহর এ কি করছি
সেটা নিয়ে উনি অবাক হচ্ছেন | একটু বিব্রত কণ্ঠেই বললেন যে ওনাদের আসলে সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখতে বলা হয়, কাস্টমার দের টাকার বিষয়ে সাবধানী না হয়ে উপায় নেই | আমিও সহাস্যে জানালাম যে সেটা ওনাদের কর্তব্য, আমাদের টাকা যে এতো সুরক্ষিত এই ব্যাঙ্ক এ, এটা জেনে আমরাও খুব নিশ্চিন্ত বোধ করি | ৬৪০ ডলার খুব কম টাকা নয় | এই টাকাতে যে ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে আসা যায় সেটাও ওনাকে জানাতে ভুললাম না | মহিলা খুব
খুশি হলেন ওনাদের এই প্রশংসা শুনে | এবং আরো নিশ্চিন্ত হলেন যখন আমি বোঝালাম যে চাকরি সূত্রেই এক শহর ছেড়ে অন্য শহর এ আসতে হয়েছে
| আগের বাড়িওয়ালা অ্যাডভান্স এর টাকা ফেরত দিয়েছেন, সেই চেকটাই জমা করার চেষ্টা করছি | মহিলা সহানুভূতির সূরে জানতে চাইলেন যে বনধু বান্ধব পরিচিত লোকজন কে ছেড়ে অন্য শহর এ এসে মন
খারাপ লাগছে কিনা | আমি স্বীকার করলাম যে মন খারাপ লাগছে | ভীষণ মন খারাপ লাগছে | প্রায় ভেঙে পড়েছি মানসিক ভাবে | যদি উনি একটু চেকটা জমা করেন তাহলে হয়তো এই দুঃখের অন্ধকারেও সামান্য খুশির আলো দেখতে পাবো | কারণ, ৬৪০ ডলার খুব কম টাকা নয় | এই টাকাতে ক্যালিফোর্নিয়া বা ভেগাস ঘুরে একটু মনটা হালকা করার চেষ্টা করবো | আমার এই মন ভালো করার পরিকল্পনা শুনে মহিলাও আশ্বস্ত হলেন | উনি চেক জমা করে নিলেন |
একটা
অজানা অনুভূতি নিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বেরোলাম | আমি কি সফল হয়েছি নাকি আমি ব্যাঙ্ক এ জালিয়াতি করেছি? নৈতিক
ভাবে আমি কি নির্দোষ? নাকি ব্যাংকের কর্মচারীদের ঠকানোর জন্য আমি নৈতিক ভাবেও অপরাধী? নকল পরিচয় ধারণ করে একজন এর টাকা তার একাউন্ট এ জমা করা
(টাকা তোলা নয়, জমা করা) কি সত্যি দোষের কাজ? নাকি দোষটা সিস্টেম এর, যে জন্য টাকা জমা করার মতো কাজ ও এতো জটিল
ভাবে করতে হয়? প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর মাথায় আসেনি, তাই আবার সেই হ্যাপি আওয়ার এ
ফিরে গেলাম | আমি দোষী ছিলাম কি নির্দোষ ছিলাম, সেই বিবেচনা আপনারাই করুন |