Friday, July 6, 2018

বিদেশ ভোজন


বিদেশ ভোজন                                                               সূর্য্য  (bsurjo03@gmail.com) 
                                                 
                                         
বলা হয় যে , মানুষ বাঁচার জন্য খায় | কিন্ত বাঙালিদের ক্ষেত্রে প্রবাদটা একটু উল্টো , বাঙালি রা নাকি খাবার জন্যই বাঁচে |  আমিও তার ব্যতিক্রম নইতাই যেদিন শুনলাম আমেরিকায় যাব , কাজ বা টেকনোলজি বাদ দিয়ে সবার আগে মাথায় এই চিন্তা এলো যে কি কি নতুন খাবার কে আক্রমন করতে পারব ওখানে গিয়ে

সেইদিনটা এখনো মনে পরে , আমেরিকা গিয়ে অফিস এর প্রথম দিনটা | ম্যানেজার সাহেব সাদর অভ্যর্থনা জানানোর পরে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন যে আমার শর্ট টার্ম আর লং টার্ম পরিকল্পনা কি | আমি অকপটে স্বীকার করলাম , যে চাকরি জীবনে কর্মসন্তুষ্টি , টেকনোলজি, কর্ম দক্ষতা বা প্রমোশন ইত্যাদি নিয়ে ভাবনাচিন্তা আলোচনা তো লেগেই থাকে , ওগুলো নিয়ে ভেবে লাভ নেই | আপাতত শর্ট টার্ম পরিকল্পনা হোলো  মার্কিন ,ইতালিয়ান , থাই , চাইনিজ ,মেক্সিকান ,আর জাপানী খাবার এর অন্তত দুটো করে দোকান এর খাবার খেয়ে দেখা | এর জন্য নিজেকে মাস দুয়েক সময় দিয়েছি | ম্যানেজার সাহেব গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলেন লং টার্ম পরিকল্পনা কি | আমি জানালাম 60 কেজি থেকে নিজেকে অন্তত 65 বা 70 কেজি তে নিয়ে যাব | উনি আমায় কাছাকাছি বেশ কিছু খাবার এর দোকান এর সন্ধান দিয়ে দিলেন | তারপরে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে নিজের চেয়ার বসে আকাশ এর দিকে তাকিয়ে রইলেন |  ওনার পাশের সীট এর আরেক কলিগ এর থেকে পরে শুনেছিলাম যে আমার সঙ্গে কথোপকথন এর পরে উনি নাকি সারাদিন সুধু মাত্র স্যালাড খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলেন | এইরকম ভোজন রসিক প্রজেক্ট মেম্বার কে দেখে মনে হয় উনি খুবই ভেঙ্গে পরেছিলেন |

যাই হোক অবশেষে পৌছালাম একটি খাবার এর দোকান | শুনেছিলাম অতি উৎকৃষ্ট  মানের বার্গার  স্যান্ডউইচ পাওয়া যায় সেখানে | দোকান ঢুকলাম | কিছুক্ষণ মেনু বোর্ড  এর দিকে  মনোসংযোগ করলাম | করে অনুধাবন করলাম যেইঞ্চি আর ১২  ইঞ্চি সাইজ এর পাঁউরুটির মধ্যে তফাত মাত্র 1 ডলার এর | এও অনুধাবন করলাম যে মুরগি , টার্কি আর গোমাংস অতি সস্তা , অপেক্ষাকৃত ভাবে মাছে দাম বেশী| এতে অবাক হবার কিছু ছিল না | কিন্ত অবাক হলাম এই দেখে যে সবচেয়ে বেশী দাম নিরামিষ বার্গার এরআমিষ এর থেকে নিরামিষ এর দাম বেশী হতে পারে এটা কখনো ভাবিনি | যাই হোক , শেষ পর্যন্ত ভাবনা চিন্তা করে মনস্থির করে ফেললাম |হাজার হোক বাঙালি মানুষ , দুপুর বেলা মাছ খেতে পেলে আর কি চাই | টুনা মাছের বার্গার খাব ঠিক করলাম

এই অবধি কোনো সমস্যা ছিল না | সমস্যা শুরু হলো অর্ডার দিতে |মহিলা জানতে চাইলেন আমি কি নেব | আমি বলে দিলাম টুনা মাছের বার্গার | মহিলা এক রাশি প্রশ্ন বান নিক্ষেপ করলেন | যার কিছুই বুঝলাম না | এও বুঝলাম মহিলাও আমার বক্তব্য বোঝেন নি | এক ভাষাতে কথা বললেও অনেক সময় উচ্চারণ এর দোষ একে অপরের কথা বুঝতে পারে না | একবার আমাদের হোস্টেল আমার এক বাঙালি বন্ধু আরেক কাশ্মিরি বন্ধুকে বলেছিল "আরে বাবা এখান্পর লোকজন কে পাস হাগ্নে কা জল নেহি হায় অর তুম চান কর নে কা জল খুজতা হায় ?" কাশ্মিরি বন্ধুটি কাশ্মিরি মিশ্রিত হিন্দিতে কিছু একটা জবাব দিয়েছিল যা আমরা বুঝতে পারিনি | আমিও ভাবলাম এইরকম কোনো ব্যাপার হচ্ছে | আমি আরো থেমে থেমে উচ্ছারন করলাম ," টু - না " | মহিলার মুখ থেকে আবার সেই এক সারি বাক্যবান ছুটে এলো | আরো একবার আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম | এইবারে মহিলার প্রশ্ন গুলো একটু বোধগম্য হলো | ওনার প্রশ্ন ছিল যে আমি কি পাঁউরুটি চাই | আটার পাঁউরুটি নাকি ময়দার পাঁউরুটি নাকি ইতালীয় পাঁউরুটি নাকি মাফিন খাবো, সেটাই ওনার প্রশ্ন |

আমি ঘাবড়ে গেলাম | ভারত বহু দোকান ফ্রায়েড রাইস খেয়েছি , ফ্রায়েড রাইস চিকেন নাকি ডিম্ নাকি চিংড়ি দেবে সেটা বললেই কাজ হয়ে যায় | কেউ তো জিগেশ করে না যে "দাদা কি দেব? সেদ্ধ চাল না আতপ  চাল না বাসমতি চাল ?" 
যাই হোক , আমি যে নতুন এসেছি এই দেশে , সেটা বুঝতে দেওবা চলবে না | ভাবলাম একটু হাবভাব দেখাই | গম্ভীর ভাবে বললাম যে বার্গার এর উপযুক্ত পাঁউরুটি দিতে | মহিলা একটু কাচুমাচু হয়ে জানালেন যে ওনার দোকানে "উপযুক্ত পাঁউরুটি " নেই | আটার পাঁউরুটি, ময়দার পাঁউরুটি, ইতালীয় পাঁউরুটি অথবা মাফিন এর মধ্যে যদি কিছু একটা বেছে নেই, উনি খুবই আনন্দিত হবেন
বুঝলাম বড় কঠিন জায়গায় এসে পরেছি | আত্মসমর্পণ করতেই হবে যে আমি কিছুই জানি না এখানকার রীতি নীতি | বলে দিলাম যে নতুন এসেছি এই দেশে, বিশেষ কিছু জানিনা | যেটা ভালো পাঁউরুটি সেটাই দিতে বললাম
মহিলা আরো সংকুচিত হয়ে জানালেন যে ওনার দোকানে "ভালো পাঁউরুটি " নেই | আটার পাঁউরুটি, ময়দার পাঁউরুটি, ইতালীয় পাঁউরুটি অথবা মাফিন মধ্যে থেকেই যদি কিছু একটা বেছে নেই, উনি খুবই আনন্দিত হবেন
ভেবে দেখলাম , বেকার পাঁউরুটি নিয়ে এত সময় আর শক্তি নষ্ট করে কাজ নেই | ময়দার পাঁউরুটি খেয়ে খেয়ে শৈশব থেকে যৌবন কাটিয়ে দিয়েছি যখন, ওটার ওপরে ভরসা রাখাই যায় | বলে দিলাম ময়দার পাঁউরুটি |

মহিলা খুবই উৎফুল্ল হয়ে বিজয়িনীর হাসি হেসে আরেক রাশ প্রশ্নবান নিক্ষেপ করলেন | বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা কি , কোন পাঁউরুটি খাবো বলে দিয়েছি , টুনামাছ খাবো সেটাও বলে দিয়েছি , তারপরেও এতো প্রশ্ন কিসের
দু একবার মন দিয়ে শোনার পরে বুঝলাম মহিলা এবারে জানতে চাইছেন "চেদার / পেপার জ্যাক  /মোজ্জারেল্লা /সুইস /ইতালিয়ান /আমেরিকান"| 

প্রথম শব্দগুলো আগে শুনিনি , কিন্তু পরের গুলো শুনে আন্দাজ করলাম মহিলা জানতে চাইছেন আমি কোন দেশ থেকে এসেছি |আমেরিকা বহু দেশের বহু জাতির লোক বাস করে |মহিলার মনের প্রশ্ন টা স্বাভাবিক | আমি জানিয়ে দিলাম যে এই গুলোর কোনোটাই নই আমি | আমি ইন্ডিয়ান ( ভারতীয়) | 

মহিলা আবার একটু লজ্জিত হয়ে জানালেন , যে ইন্ডিয়ান হবে না, কিন্তু চেদার / পেপার জ্যাক  /মোজ্জারেল্লা /সুইস /ইতালিয়ান /আমেরিকান এর মধ্যে যেকোনো একটা আমি বেছে নিতে পারি
বুঝলাম মহিলা আমার দেশ বা জাতি জানতে চাইছেন না | কিন্তু তাহলে আমায় কি বেছে নিতে বলছেন ? আমায় নিশ্চই নাগরিকতা বদল করতে বলছেন না | শুনেছিলাম অন্য দেশের নাগরিকতা পেতে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়  | এইরকম একটা বার্গার এর দোকান নানা দেশের নাগরিকতা বিলি হচ্ছে , সেটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হলো না

একটু আন্দাজ করার জন্য জানতে চাইলাম যে এগুলোর মধ্যে কোনটা ভালো | মহিলা আরো একটু লজ্জিত হয়ে বললেন যে সবকটাই ভালো, ওনার দোকানে খারাপ হওয়া সম্ভব নয় | যদি আমি চেদার / পেপার জ্যাক  /মোজ্জারেল্লা /সুইস /ইতালিয়ান /আমেরিকান এর মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নেই তাহলে উনি খুবই আনন্দিত হবেন

হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম চেষ্টা করে দেখাই যাক | কথায় আছে যস্মিন দেশ যদাচার '| আমেরিকাতেই আছি যখন তখন বলে দিলাম আমেরিকান | মহিলা খুব খুশি হয়ে দেখলাম কোথা থেকে  একটা চিজ এর গামলা বার করে নানা রকম বাটির মধ্যে একটা বাটি থেকে খানিকটা চিজ বার করে লাগিয়ে দিলেন | বুঝলাম যে অপশন গুলো চিজ এর ছিল | আমি এতদিন একটাই চিজ জানতাম ভারতে , আমূল চিজ | চিজ এর যে এতরকম জাতি বর্ণ রয়েছে কে জানত ?


যাই হোক , অবশেষে আরো নানান প্রশ্নবাণ পেরিয়ে খাবার অর্ডার করা শেষ হলো| এবারে মহিলা জানতে চাইলেন আমি কোনো রকম এর পানীয় কিম্বা চিপস চাই কিনা | চাই না শুনে উনি অবশেষে বললেন ডলার দিয়ে যেতে | আমি জিগেশ করলাম কিভাবে পেমেন্ট করবো | ডেবিট কার্ড , নাকি ট্রাভেলার কার্ড নাকি ক্যাশ ? মহিলার জবাব , "এনিথিং ইজ ফাইন "| আমি দেখলাম এই সুযোগ | এতক্ষন ধরে এতরকম অপশন বলে বলে যা যন্ত্রনা দিয়েছেন তার শোধ তোলার সুযোগ পাওয়া গেছে | খুবই দুঃখিত হয়ে বলে দিলাম , যে আমার কাছে একেবারেই "এনিথিং" নেই, সামান্যতম পরিমাণও "এনিথিংনেই | থাকলেই অবশ্যই "এনিথিং" দিতাম | কিন্তু আজকের মতো উনি যদি ডেবিট কার্ড , ট্রাভেলার কার্ড কিংবা ক্যাশ নিতে রাজি হয়ে যান তাহলে আমি ভীষণই আনন্দিত হবো | মহিলা দেখলাম কিরকম একটা হকচকিয়ে গিয়ে তাকালেন | কি আর করা, একেই বলে যস্মিন দেশ যদাচার !!

8 comments:

  1. Excellent!!! Bideshe amader gie first hand experience ekkebare accurate tule dhorechho...
    Are porar opekkhae roilam.

    ReplyDelete
  2. Sweet and crispy. Nice flow with good command over the language. Excellent practical sense of humor. We will definitely look for more!

    ReplyDelete
  3. খুব ভালো zone, লিখে যাও।

    ReplyDelete
  4. Surjo babu, bhalo likhechen. Pore mone holo kon ek bondhur mukhe shunechi :-) khub sundor narration. bhalo laglo :-)

    ReplyDelete
  5. Bah very nice read with a humor touch.. Remembered my initial days..keep writing!!

    ReplyDelete
  6. asadharon akta lekha mone hoy jeno samne boshe sunchi...khub lively...

    ReplyDelete

বিদেশে বাণী বন্দনা

  প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় ...