Saturday, August 8, 2020

দূর্গা - অসুর সংবাদ

                      নারদ : এই অসুর, ওঠ না, আর কত ল্যাদ খাবি

অসুর: ও বাবা, তুই এসেছিস ? কি হলো আবার ?
নারদ : কি হলো আবার ? শরৎকাল, আশ্বিন মাস, এখন কি হয় সেটা ভুলে গেলি?
অসুর: না, কিছু ভুলিনি , বছর বছর ওই দশটা হাত আর গাদাকতক প্রিমিটিভ weapons আর একটা বুড়ো সিংহকে দিয়ে আমার মতো বীরপুরুষ কে কুপোকাত করার চক্রান্ত
নারদ : তাহলে এবার ওঠ, একটু গতর টা নাড়াচাড়া কর, জিম এ যা, বডি বানা, নইলে তো ফেসবুকে ভালো ফটো আসবে না 
অসুর:  এবছর যে করোনা মহামারী, চারদিকে LOCKDOWN আর QUARANTINE , এর মধ্যে পুজো হবে ?
নারদ : একি কথা, QUARANTINE বল আর করোনা বল , পুজো হবে না বললে বাঙালি ফেস্টিভ্যাল করবে কি করে ? 
অসুর: ধুত্তোর আমি যাবোনা , দুর্গার সঙ্গে মারপিট টা জুম্ মিটিং এ করা যাবে না? কলকাতা গেলেই তো দুসপ্তাহ QUARANTINE , ফিরে এসেও আবার QUARANTINE 
নারদ : জানি রে জানি । ঐজন্যই তো এইবছর মহালয়ার পাঁচ সপ্তাহ পরে পুজো , মাঝের সময়টা QUARANTINE 
অসুর : QUARANTINE তো দুসপ্তাহ হয় , এতদিন কেন? 
নারদ : পুজো শপিং করার জন্য, আগে তো সবাই ভিড় করে গুতোগুতি করে কেনাকাটা করতো , কিন্তু এখন তো সেসব হবে না।

                     অসুর :  কেন?

নারদ : সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ করতে হবে, অল্প অল্প লোক দোকানে ঢুকবে তাই বেশি সময় দেয়া 
অসুর :সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ ?
নারদ :  হ্যা রে , এটাই তো নিউ নরমাল 
অসুর: তাহলে এই নিউ নরমাল এর যুগে সোসিওপলিটিক্যাল stereotype ভেঙে আমাকে এবার জিততে দেয়া হোক
নারদ: ওবাবা, এইসব খটোমটো শব্দ কেন? একটু সাদা বাংলায় জলবৎ তরলং করে বল না
অসুর: উহু, আমি এইভাবেই বলবো। ইংরেজি ওয়ার্ডস আর phrases use না করলে আজকাল ভদ্র সমাজে পাত্তা পাওয়া যায় না । বাংলা কথা বলা লোকদের কেউ পাত্তা দেয়না ।
নারদ: একি কান্ড, তুই তো দেখছি বোকা বাক্সর পন্ডিত দের মতো কথা বলছিস , মধ্যবিত্ত বাঙালি অসুর, অসুর এর মতো থাকনা , ভদ্রলোক হওয়া দরকার কি তোদের মতন অসুরদের ?
অসুর: ভদ্র্লোকরাই তো আসল অসুর রে, যেইরকম দুর্নীতি আর মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে এই ভদ্রসমাজে , অসুররা নিজেদের identity হারিয়ে ফেলবে এরকম না হতে পারলে
নারদ: আচ্ছা ঠিক আছে, সেইসব কথা থাক। কি চাই তোর সেটা বল
অসুর: বলছি তো। আমি এইবারে হারবো না, আমায় ম্যাচফিক্সিং করে এবারে জিতিয়ে দে
নারদ : সেকি কথা, নারী শক্তির পরাজয়? আসুরিক শক্তির জয়? আমাদের হেরিটেজ এর কি হবে?
অসুর: হেরিটেজ বিলডিং ভেঙে তো ফ্ল্যাট আর মাল্টিপ্লেক্স তৈরী হচ্ছে, তোরা আবার হেরিটেজ নিয়ে কথা বলিস কি রে  
নারদ : আরে সেই হেরিটেজ নয়, আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলছি। ঐতিহ্য কি ভেঙে দেয়া যায় রে?
অসুর: এই বেশি বাতেলা মারিস না তো , তোরা বিদ্যাসাগর এর মূর্তি ভাঙতে পারিস, আর একটু ঐতিহ্য ভাঙতে পারবি না ? হ্যারে, তোরা পুজো করিস তো প্রাইজ পাবি বলে, তাই নিয়ে এতো ঢং করার কি আছে?
দূর্গা : এই অসুর, কি বক বক করছিস বল তো তখন থেকে ? আর এই নারদ, ওকে রেডি করিয়ে রাখিস নি কেন? 
নারদ : আরে আমি কখন থেকে try করছি, ও বলছে কিনা ম্যাচফিক্সিং করে ওকে জিতিয়ে দিতে হবে 
দূর্গা : এই যে মাথামোটা, ম্যাচফিক্সিং করবে ?
অসুর: হ্যা, করবো।
দূর্গা : ম্যাচফিক্সিং আজকাল বেআইনি /  যদি আমি রিপোর্ট করি তোর কিন্তু জেল হয়ে যাবে
অসুর: জেল এ যাওয়া তো গর্বের ব্যাপার। স্বদেশী আন্দোলন এর সময় থেকে আজ পর্যন্ত্য দেখসি, সমস্ত নাম করা নেতারাই তো জেল এ যায় 

                       নারদ : আগে  কিন্তু criminal দের সোশ্যাল মিডিয়া তে ট্রলিং হতো না।  টুইটার এ                              UNFOLLOW করার ভয় ও ছিল না , আজকাল কিন্তু এই সব হচ্ছে  

দূর্গা : সোশ্যাল মিডিয়া তে UNFOLLOW হয়ে গেলে  কিন্তু public sympathy পাবি না, স্পনসর ও পাবি না
অসুর: ও বাবা, তাহলে জেল চাই না 
দূর্গা : নে, রেডি হো, এবারে 
অসুর : এখন কেন রেডি হব? নারদ বললো যে  পুজো শুরু হতে ঢের দেরি আছে 
দূর্গা :  ব্যাকডেটেড মুখ্যু তুমি । প্রেস কনফারেন্স, মিডিয়া কাভারেজ , campaigning, এইসব শোনোনি ?
মেয়ে : এক মিনিট , এক মিনিট,  এইসব কি হচ্ছে?  প্রসেস আছে তো 
নারদ : আজ্ঞে আপনি কে দেবী?
মেয়ে: আমি জীবন বাংলা চ্যানেল থেকে এসেছি, দেবী আর অসুর এর বিগ ফাইট এর লাইভ টেলিকাস্ট করবে আমাদের চ্যানেল , এবং এই ফাইট টা নিবেদন করছে handloom  হ্যান্ডওয়াশ , surprise  সাবান,  চরম চানাচুর 
নারদ : আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, জীবন বাংলা ব্যাপার টা কি? আর দেবী অসুর এর লড়াই এর সঙ্গে সাবান আর চানাচুর র কি সম্পর্ক?
মেয়ে : কোথাকার ব্যাকডেটেড মানুষ হে আপনি? জীবন বাংলার নাম শোনেন নি? World er best  বাংলা চ্যানেল আমাদের জীবন বাংলা । বিজ্ঞাপন মানেই জীবন বাংলা , আমাদের চ্যানেল সেই number 1 চ্যানেল যেটা, এমা উঠে গেছে     
নারদ : যা , চ্যানেল উঠে গেছে ?
মেয়ে : আরে দূর, আমার নেইলপলিশ টা উঠে গেছে, খেয়াল করলাম এখুনি। 
নারদ : কি বিরক্তিকর ব্যাপার। আরে এই বিগ ফাইট এর মধ্যে আপনি বাগড়া দিচ্ছেন কেন?
মেয়ে: কিছু জানেন না আপনি, আজকাল যেকোনো বিগ ফাইট এর আগে টক্ শো হয় 
নারদ : টক ডাল জানি, কিন্তু টক্ শো? 
মেয়ে: সিনেমার আগে যেমন ট্রেইলার হয়, সেইরকম বড় ঝাড়পিট এর আগে আমার দুপক্ষ কে টিভি তে এনে ঝগড়া করাই, এতে TRP বাড়ে 
নারদ : ঝগড়া থেকে TRP ? আমি তো শুনেছিলাম যে বুদ্ধদেব গান্ধীজি র দেশ এ সবাই চায়  শান্তি আর ভালোবাসা 
মেয়ে : ঐসব বলার জায়গা শুধু পরীক্ষার খাতা আর ইতিহাস এর পাতা । রিয়েল লাইফ এ ঝগড়া ঝাটি কেচ্ছা কেলেঙ্কারি - এইসব নিয়ে PNPC  - এগুলো তো পাবলিক খায় 
নারদ : ও বাবা ঝগড়া লাগানোর কাজ যদি TV চ্যানেল করে তাহলে আমি এবারে কি করবো ? আমার ও তো দেখছি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস !!
মেয়ে : নিন, শুরু করুন। একদিকে দেবী () একদিকে অসুর (), আর এই যে মশাই আপনি কোন দিকে ?
নারদ : আমি আবার কোন দিকে ?
দূর্গা : এই নারদ, তুই কি অসুর নাকি ?
নারদ : এই  না না 
দূর্গা : তাহলে তুই আমার দিকে 
অসুর : ওই নারদ, পাল্টিবাজ কোথাকার, তুই মহিলা না পুরুষ ? কোন দলের ?
মেয়ে : Look, আপনারা ক্যান্ডিডেট কে প্রেসার দিচ্ছেন, ডিসকোয়ালিফাই করে দেব। হ্যা আপনি বলুন তো আপনি কোন টীম এর?
নারদ ; আমি ভাবছিলাম যে নিউট্রাল থাকি, নাকি ?
মেয়ে : সেরকম হয় নাকি?
নারদ: এই তো কয়েকদিন আগেই কলকাতায় একটা চরম দলাদলি হলো।  এক দল জিগেশ করলো তোরা বাঙালি না গুজরাটি কোন দলে ? একদল জিগেশ করলো যে তোরা ওই মহিলার দলে নাকি আমাদের পুরুষ সিংহের দলে? 
মেয়ে: তারপরে?
নারদ: তারপরে আবার কি, কলকাতার ওয়ার্ল্ড ফেমাস  কিছু লোক বললো আমরা নিউট্রাল । দলাদলি শেষ হয়ে গেলো, কিন্তু আজ অবধি কেউ বুঝতে পারেনি এরা কোন দলে
মেয়ে : তাহলে আপনি চিয়ারলিডার টীম এ 
নারদ: চিয়ারলিডার? সেটা কি?
মেয়ে: যারা নিউট্রাল,  তাদের জন্য একটা  গ্ল্যামারাস টীম বানিয়েছি আমরা। They are so neutral, যে  ব্যাটসম্যান ৬ মারলে ও dance করে , ব্যাটসম্যান আউট হলেও dance করে । ক্রিকেটার দের জল খাওয়া থেকে ফিল্মস্টার দের মদ খাওয়া, সব কিছুতেই এরা cheer up করে mental support বাড়ায় । আপনি যান, আমার crew আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবে 

                        নারদ: আচ্ছা আমি তাহলে cheer leader হয়ে যাই 

মেয়ে : যাই হোক, এবারে বিগ ফাইট এর টক্ শো । শুরু হোক। লেডিস ফার্স্ট 
দূর্গা : এই ফাইট এ আমি জিতবো, আমার জেতা উচিত। আমি রিপ্রেসেন্ট করি নারী শক্তি, আমি রিপ্রেসেন্ট করি নারী মুক্তি, আমি রিপ্রেসেন্ট করি ফেমিনিজম 
অসুর : নিকুচি করেছে তোর ফেমিনিজম এর । সবচেয়ে বড়ো ফেমিনিস্ট তো আমি। আমি বছর বছর এক মহিলার কাছে পড়ে পড়ে কেলানি খাই যাতে বাঙালি মহিলারা ফেস্টিভ্যাল স্পিরিট এ শপিং করতে পারেন, আর নিজেদের সুন্দরসুন্দর মুখগুলোর সেলফি আপলোড করতে পারেন 
মেয়ে : দারুন পয়েন্টস। রাউন্ড ১ অসুর 
দূর্গা : অত সহজ নাকি জেতা? হ্যারে অসুর, তোর পেছনে পার্টি ফান্ড বা ফিনান্সিয়াল ব্যাকিং আছে?
অসুর: না, আমার পেছনে মোষের ল্যাজ আছে 
দূর্গা: শুধু  ল্যাজে কি হবে? আমি ওয়াইল্ডলাইফ সাপোর্ট করি ।  সিংহ আছে । তোর কি ওয়াইল্ডলাইফ সাপোর্ট আছে?
অসুর : হ্যা, আছে তো। মাথায় উকুন আর পেট এ কৃমি আছে ।
দূর্গা : ইসঃ!
মেয়ে : রাউন্ড ২ দূর্গা 
অসুর: আমি জিতবোই । আমাকে জিততেই হবে। আমি রিপ্রেসেন্ট করি সাধারণ মানুষ কে। আমি বুদ্ধিজীবী নোই, আমি বোকা।মাথার বাইরে শিং আর ভেতরে গোবর। আমি সেই কমন ম্যান যে পড়ে পড়ে মার্ খায় যাতে ভদ্রসমাজ ফেস্টিভ্যাল করতে পারে । 
দূর্গা : পাবলিক সিম্প্যাথি নেয়া হচ্ছে? আমার সিচুয়েশন শুনবি? এই জীবন বাংলার সব কটা সিরিয়েল এর নায়িকাদের টোটাল যা ক্রাইসিস আমার নিজের ক্রাইসিস তার থেকে ও বেশি 
অসুর : কি ঢপ
দূর্গা : এই, তুই জানিস কিছু? আমার হাসব্যান্ড এমনিতে সেরা, কিন্তু লাইফস্টাইল সাধারণ বলে আমার বাবা এমন অপমান করেছে যে ও আর আমার বাপের বাড়ি যায়না কোনোদিন,

                       মেয়ে : Thats terrible.... 

দূর্গা : ছেলেটা র মুখেভাত দেবো, সেই অনুষ্ঠান এ এমন ক্রাইসিস পুরো মাথা ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি করতে হলো। 

                       নারদ : উফফ সে যা কান্ড  হয়েছিল, এখনো ভাবলে শিউরে উঠি  

দূর্গা :  নারীমুক্তি নারীশক্তি এইসব করার জন্য মেয়েদের অনেক পড়ালাম। বড়ো মেয়ে লেখাপড়া গান বাজনা, নাচ, আবৃত্তি, ছবি আঁকা , সব কিছুতেই তুখোড়, কিন্তু আজ অবধি পছন্দসই পাত্র 
পেলাম না। ছোট মেয়েটা বিয়ে করেছে , কিন্তু জামাই বাবাজীবন সবসময়ে শয়নে পদ্মনাভঞ্চ হয়ে শুয়ে থাকে , নয়তো এদিক ওদিক লীলাখেলা করে বেড়ায় 
অসুর : সত্যি নাকি? 
দূর্গা : তা নয়তো কি? এইসব চাপ দেখে আমার বর রোজ ওই শশান  এ বসে হ্যাপি আওয়ার করে। ওই আপদ নন্দী আর ভৃঙ্গী ও জুটেছে আস্কারা দেয়ার জন্য । 
অসুর: হ্যা রে দূর্গা, তোর এতো দুঃখ, তুই আমায় বিয়ে কর না?
দূর্গা : কি বলি? 
অসুর : দেখ, আমি রোজ রোজ হ্যাপি আওয়ার করবো না, গাঞ্জা ও খাবো না। প্লাস আমি অসুরদের রাজা, তোর বাপ্ পাহাড় দের রাজা, তাই অপমান ও করবে না ।একদম দারুন জুটি 
দূর্গা : আহা, শখ কত ব্যাটা মোষের। নে  মর (ত্রিশূল )
অসুর: আরে একি করলি রে। প্রপোস করেছিলাম, না বললেই পারতিস, ম্যাক্সিমাম একটা চড় মারতে পারতিস, ত্রিশূল মেরে দিলি? কে আছিস জয়োধ্বনি দে ।
নারদ :: সে আবার কি। loser  দের আবার জয়োধ্বনি হয় নাকি? cheer leader হয়েছি যখন লিডার দের cheer করবো, loser দের cheer করবো কেন ? বোলো দূর্গা মাই কি জয় । আসছে বছর আবার হবে 

Monday, August 3, 2020

তিনটি বিয়ের গপ্পো

প্রথম বিয়ে :  নব্বই এর দশক।  আমার এক কাকার বিয়েতে কলকাতার বাইরে এক মফস্বলে গিয়েছি । সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, নিজেকে বেশ বড়ো মনে করি তখন। তাছাড়া মাবাবা ও কেউ সঙ্গে যায়নি। 'বেশি পাকামি কোরোনা' জাতীয় কথা বলার কেউ নেই। তাই সুযোগ পেলেই যেকোনো কাজের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করছি। অবশেষে বিয়ের দিন সকালে একটা গুরুতর কাজের দায়িত্ত্ব পেলাম।  পাত্রীর বাড়ি তে গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ত্ব ।

বিয়ের দিন সকালেই আমার বড় কাকা  অসুস্থ হয়ে পড়েন, ওনার ওপরেই দায়িত্ত্ব ছিল তত্ব পার্টি কে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার । ওনার অসুস্থতার কারণে আমিই তখন একমাত্র অবশিষ্ট । আমার একটু কৌতূহল হলো " আচ্ছা এই বিয়েতে আমি কি একা বরযাত্রী?"

যেই কাকার বিয়ে তিনি বোঝালেন "না রে, আমার তিন জন মামা ও তাদের পরিবার ও আসবেন, আর খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী ও  ট্রেন এ করে আসছে"

আমি একটু অবাক হলাম "সেই তিন মামারা কেউ তত্ব নিয়ে যাবেন না ?"

কাকার উত্তর " আজকে তো বুধবার, ওদের অফিস আছে, ওদের ছেলে মেয়েদের স্কুল আছে, তাই ওরা সন্ধ্যে বেলায় আসবে বলেছ। দাদার যে শরীর খারাপ হয়ে যাবে , সেকথা ওরা কি করে জানবে বল?"

জিগেশ করলাম " আর তোমার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী?"

কাকা উদাস ভাবে বললেন " ট্রেন লেট্ আছে খবর পেলাম, সকাল আটটায় আসার কথা ছিল, শুনছি বিকেল চারটেয় ঢুকবে। "

তারপরে একটু উৎসাহ নিয়েই বললেন "তুই তো এখন বড়ো হয়েছিস, তোকে আরো একটা কাজ দেব । তুই বিকেল এর দিকে স্টেশন এ চলে যাস , যদি শুনিস যে ট্রেন আরো লেট হবে তাহলে আমার শ্বশুরমশাইকে বলিস যে বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে । আমি তুই আর বাবা বরের গাড়িতে চলে যাবো। "

আমি একটু অবাক হলাম "তোমার তিন মামা কি করে যাবেন?"

কাকা এক গাল হাসলেন "ওরা তো আমার শ্বশুরবাড়ির দুটো গলি পেরিয়ে থাকে , ওদের ফোন করে দিবি , ওরা হেঁটেই চলে যাবে "

কাজের দায়িত্ত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে । আমি তাও জিগেশ করলাম " তোমার মামারা আমায় চিনবেন?"

কাকা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, " নিশ্চই চিনবে , আমার পৈতের অনুষ্ঠানে তোকে দেখেছিলো , তুই তখন সবে হাঁটা  শুরু করেছিস , কত্ত খেলা করেছিল তোর সঙ্গে "

এরপরে আর নিশ্চিন্ত না হয়ে থাকা যায়না।  কিন্তু শেষ প্রশ্ন টা তাও করেই ফেললাম "হঠাৎ করে যদি বলি বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে তোমার শ্বশুরমশাই আমার কথা শুনবেন? "

 কাকা আস্বস্ত করলেন "নিশ্চই শুনবেন, তাই তো তোকেই পাঠাচ্ছি তত্ব নিয়ে।  একবার তত্ব নিয়ে গেলে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই তোকে চিনে যাবে, সবাই জানবে তোর ওপর আমাদের সবার এতো ভরসা আছে । তুই যা বলবি সবাই সেটাকে গুরুত্ত্ব দেবে।  তাই তো বলছি আর দেরি না করে বেরিয়ে পর,আর আমার শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমিয়ে ফিরবি "

এরপরে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।  তাই অবশেষে আমি এই গুরু দায়িত্ত্ব গ্রহণ করলাম।  ছোটবেলায় বিয়েবাড়ি বলতে খাওয়া দাওয়াই বুঝতাম, অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতাম না ।  কোনো এক বিয়েবাড়িতে তো পাত্র পাত্রীর সঙ্গে দেখাও করিনি, সোজা খেতে বসে গিয়েছিলাম ।  এই প্রথম তত্ব জিনিষটা জানলাম। এখনকার বাঙালি পাঠক পাঠিকাগন সবাই নিশ্চই জানেন তত্ব ব্যাপারটা।  তাই সেটা নিয়ে বিশেষ বর্ণনা করার চেষ্টা করছি না । কিন্তু তখনকার দিনে এতো আড়ম্বর ছিলনা । সুসজ্জিত গাড়ি নয়, সাধারণ  সাইকেল রিক্সা করে আমি যাত্রা শুরু করলাম। দু হাত এ দই আর মিষ্টির হাঁড়ি,  পায়ের নিচে জোড়া ইলিশ, আর কোলে শাড়ীর বাক্স নিয়ে আমি চলেছি । রিক্সাওয়ালা কে সারা রাস্তা ধরে অনুরোধ করে গেলাম আস্তে চালানোর জন্য, নইলে হাত থেকে হাঁড়ি পিছলে যাবে।  রিকশাওয়ালা ও ক্রমাগত বলে গেলো “দাদা আরেকটু জোরে চালাতে দিন, নইলে স্কুল ছুটির সব প্যাসেঞ্জের হাতছাড়া হয়ে যাবে”। 

অবশেষে হবু কাকিমার বাড়ি পৌছালাম। মিষ্টি শাড়ি ইত্যাদি হাত বদল হলো, সৌজন্য বিনিময় , চা শরবত সহযোগে পরিচয়পর্বের মাঝে খবর পেলাম রিক্সাওয়ালা আবার ফিরে এসেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দিলাম, আন্দাজ করলাম যে ওকে টাকা দেয়া হয়নি।

রিক্সাওয়ালা এক গাল হেসে বললো, “ দাদা জোড়া ইলিশটা তো রিকশাতেই রয়ে গেলো, কেউ তো নামালেন না, তাই আবার দিতে এলাম, এই আঁশটে গন্ধ নিয়ে কি আর স্কুল এর প্যাসেঞ্জের পাবো” ! কলকাতার রিক্সায় একবার একটা টুপি ফেলে এসেছিলাম, সেটা আর ফেরত পাইনি। তাই  মফস্বলের এই  সরল কিন্তু সৎ রিক্সাওয়ালার কথা আলাদা ভাবে মনে রয়ে গেছে | 

 

 

দ্বিতীয় বিয়ে : পরের ঘটনাটি আমার এক মাসতুতো দাদার বিয়ে  ততদিন  দশক , শতাব্দী সব বদলে গেছে   বাঙালিদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রাও কিছুটা বদলে গেছে|  বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো একটু আড়ম্বর করে না করলে বাকিরা নিন্দা করেন তাই সব অনুষ্ঠান এখন আর পঞ্জিকার তিথি দেখে হয়নানামকরা ক্যাটারের আর ভালো বিয়েবাড়ি কখন পাওয়া যায় সেই অনুযায়ী হয়। আমার এই দাদাটি (এবং হবু বৌদিআমেরিকায় থাকেওর ছুটির সুবিধে এবং কলকাতার সেরা বিয়েবাড়ি পাওয়ার সুবিধে দুটো মিলিয়ে মিশিয়ে পৌষমাসে বিয়ে ঠিক হলো।

ততদিনে আমি তত্ব নেয়ার ব্যাপারে পারদর্শী হয়ে গেছি। আমি ঘোষণা করলাম " আমি তত্ব নেয়ার ব্যাপারে এখন এক্সপার্ট  কবে নিতে হবেকোথায় নিতে হবে বোলো।"

মাসিমা বুঝিয়ে বললেন "ঐসব চিন্তা নেইসব কিছু outsourced  "

আমার হতভম্ব মুখ দেখে দাদা বোঝালো "আরে বুঝিস নাআমি আর তোর বৌদিসবাই বিদেশ  থাকিআমাদের বন্ধুদের ভালো করে ফটো আর ভিডিও দেখাতে হবে তো। তাই এখন প্রফেশনাল আর্টিস্ট ভাড়া করেছি তত্ব সাজানোর জন্য  "

আমি একটু অবাক হলাম "তত্ব মানে তো কয়েকটা শাড়ি আর মিষ্টিওতে সাজানোর কি আছে?"

দাদা বোঝালো "ফটো তে যাতে ভালো দেখায়তাই এখন অনেক ডেকোরেশন করতে হয়। মিনিমাম সংখ্যার জিনিষকে ম্যাক্সিমাম সংখ্যার ডালায় সাজানোঘরের লোকজন কি পারে ওই আর্টিস্ট লেভেল এর সাজাতে? "

আমি একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম "বৌদির বাড়ির তত্ব  কি outsourced ?"

দাদা উৎসাহের সঙ্গে বললো "হ্যা রেএক আর্টিস্ট করছেযাতে ব্যাপারটা same লেভেল এর হয়  আর তাছাড়া ডিসকাউন্ট  আছে "

আমি অবাক হয়ে গেলাম "তত্ব সাজানোর  ডিসকাউন্ট ?"

দাদা বোঝালো "হ্যা রেদুটো ফ্যামিলি একসঙ্গে কন্ট্রাক্ট দিলে কুড়িছাড়আমরা তো ঐজন্যই দুই বাড়ির কাজও এক পুরোহিত দিয়েই করাচ্ছি। ওখানেও ডিসকাউন্ট !"

আমি হাল ছেড়ে দিলাম "তাহলে আমায় কি করতে হবে?"

মাসিমা উৎসাহের সঙ্গে বললো "তুই বরং জুতো পাহারা দিসবিয়েতে একটা নিয়ম আছে না জুতো লুকিয়ে রাখার ?"

আমি একটু চিন্তিত হয়েই বললাম " আমি কিন্তু কোনো বিয়েতে কারোর জুতো লুকিয়ে রাখার নিয়ম দেখিনি , যদিও এটা ঠিক যে  খাওয়া দাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু আমি খেয়াল করতাম না আগে "

দাদা একগাল হেসে বললো "কি যে বলিসবলিউড এর সিনেমায় দেখিস নি?"

আমি প্রতিবাদ করলাম "সেটা তো সিনেমা!"

দাদা বললো "আরে তুই বুঝিস নাআমেরিকায় গিয়ে যখন সবাইকে বিয়ের ছবিভিডিও ইত্যাদি দেখাবোওরা তো সিনেমায় যা দেখে তারসঙ্গে মিলিয়ে দেখবে যে BIG INDIAN WEDDING হয়েছে কিনা। তোর বৌদি কিন্তু আগেই বলে রেখেছেএকটুও খুঁত থাকলে চলবে না , একদম বলিউড স্টাইল এর BIG INDIAN WEDDING চাই "

আমি বুঝলাম যে এটাই এখনকার নীতি , মানিয়ে নেওয়া ভালো। সিনেমাতে জুতো লুকোনোর পরে যে টাকা দেয়া দেখায়  সেটাও হবে কিনা জানতে চাইলাম  মাসিমা খুব উত্তেজিত হয়ে ফোনের দিকে ছুটে গেলেন বৌদির বাড়িতে ফোন করতে 

"আচ্ছা জুতো  ব্যাপারটা হচ্ছে তো?"

জুতোমানে জামাইকে নতুন জুতো দিচ্ছি কিনা জানতে চাইছেনওটা মনে হয় তত্ব  সঙ্গে যাবে। বিয়ের মণ্ডপে চাই নাকি?"

"আরে না নাআমি জুতো লুকোনোর কথা বলছিলাম "

" আচ্ছাহ্যা মানে আমি ঠিক জানি না , কেন বলুন তো?"

আসলে কতজন ভাইবোন মিলে লুকোবে সেটা জানা থাকলে সেইমতো একটা হিসেবেমানে সেইমতো একটু ক্যাশমানে বুঝেছেন তোমানে আজকাল যেরকম দেখায় টিভি তে "

"ওহ আচ্ছা আচ্ছাবুঝেছি  দাঁড়ানএকটু পরেই জানাচ্ছি "

আধঘন্টার মধ্যেই বৌদির বাড়ি থেকে খবর এলো যে মামাতো মাসতুতো খুড়তুতো পিসতুতো বাহিনী মিলিয়ে  ওরা মোট পঁচিশ ভাই বোন। মিনিট দশেক পরে খবর এলো যে বৌদির কিছু বান্ধবীও যোগদান করবেন এই জুতো চুরির মহান কর্মযজ্ঞে , তাই মোটামুটি পঁয়ত্রিশ জনের হিসেবে করে আসাই ভাল। মাসিমা কাগজ পেন নিয়ে হিসেবে করে দাদাকে বললো যে মাথাপিছু দুশো ধরে নিয়ে সাত হাজার ক্যাশ রেডি করে আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে।  সাত হাজার ডলার শুনে দাদা আর্তনাদ করে উঠেছিলকিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই সামলে উঠলো যখন মাসিমা   বোঝালেন ওটা সাত হাজার টাকাসাত হাজার ডলার নয়  সেই মতো আমরা সন্ধ্যাবেলায় রওনা হলাম। 

আমি ভাই হিসেবে খুবই কর্তব্যপরায়ণ। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে সারা সন্ধ্যে জুতো পাহারা দিয়েছিলাম  এতই নিষ্ঠার সঙ্গে পাহারা দিয়েছিলামযে বিয়েতে কন্যা সম্প্রদানের পরেই বৌদির বাবার গর্জন শোনা গেলো  "আমার চটি কে লুকিয়ে রাখলি রে ? আজ অবধি কোনো বিয়েতে মেয়ের বাবার জুতো লুকোনো দেখিনিসিনেমাতেও না ! "

কি আর করাআমি তো দায়িত্ত্ব নিয়ে দাদার চটি সামলে রেখেছিলাম , বাকিরা তাই ভুল করে দাদার শ্বশুরমশাইয়ের চটিজোড়া হাতিয়ে নিয়ে গেছে  ওদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায়না, আসলে দুই জোড়া চটি তো এক দোকান থেকে একসঙ্গেই কেনা, ওখানেও তো ডিসকাউন্ট !!

 

 

তৃতীয় বিয়ে : আরো একটি দশক পেরিয়ে গেছে। বাঙালিদের বিয়ে এখন পুরোদস্তুর BIG INDIAN WEDDING স্টাইল এর সাড়ম্বর বিয়ে।  এক দশক আগেই তো  কুষ্ঠি – ঠাকুরমশাই - পঞ্জিকা ছেড়ে ক্যাটারের - ডেকোরেটর এর মর্জিমতো বিয়ের দিন ঠিক হতো  এই দশক  দেখা গেলো অনুষ্ঠানের  প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া হয় ফটোগ্রাফার এর মর্জি মতো।  ফটো ঠিকমতো ফোকাস না হলে  বারের জায়গায় - বার  মালা বদল করতে হয়। আগুন এর ঔজ্জ্বল্যর সঙ্গে বৌয়ের বেনারসির ঔজ্জ্বল্য যতক্ষণ না মিলছেততক্ষন অবধি বর বৌ আগুনের ধারে পাক খেয়েই যায়অনেকসময়  সাত এর বেশি। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে আবার ক্যাটারের , ডেকোরেটর ইত্যাদিকে দেখাশোনা করার জন্য ইভেন্ট ম্যানেজার থাকেনবাড়ির কোনো আত্মীয়কে সেই দায়িত্ব নিতে হয়নাওনারা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে সেলফি তুলতে থাকেন।

পরের ঘটনা সেইরকম যুগের একটি বিয়ের  আমেরিকা থেকে ছুটিতে দেশে এসেছিসেইসময়ে এক বান্ধবীর বিয়ে  বিয়েবাড়িতে সিঁড়ির মুখে একটা হোঁচট খেয়ে পুরো একটা দরজার ফুলমালা ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলেছি। বেশি কেউ দেখার আগেই ব্যাপারটা সামলে ফেলতে হবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি ডেকোরেটর কে ডেকে আনলাম। ঠিক এই সময়েই বরযাত্রীরা দলবল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনিহঠাৎ পেছন থেকে ক্রূদ্ধ তরুণী কণ্ঠ ভেসে এলো "আপনার কি কোনো আক্কেল নেইদেখছেন যে বর বেচারি অনেক কষ্টে ধুতি সামলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেআর সেখানে আপনি রাস্তা আটকে কি   করছেন?"

নিজের ভুলটা যথা সম্ভব চেপে রাখাই ভালো। তাই আমি একটু আমতা আমতা করেই বললাম "ওই একটু ফুলগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছি

তরুণী আবার গর্জে উঠলেন "আচ্ছা বলুন তোবিয়েতে কোনটা বেশি দরকারফুল দিয়ে সাজানো গেট নাকি বর?"

আমি ওনাদের কে বরযাত্রীদের ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে  নিরীহ ভাবেই বললাম "আমরা তো জানি যে বর  বেশি দরকারিকিন্তু আজকালের বরবৌরা আবার সাজসজ্জার দিকেও খুবই গুরুত্ত্ব দেননইলে ছবি ভালো আসে না"

তরুণী দেখলাম একটু শান্ত হলেন "হ্যা এটা একদম ঠিক কথাই বলেছেনভালো করে সাজান না যত পারেনআমি খালি ভয় পাচ্ছিলাম ঐটুকু   জায়গা দিয়ে বর যেতে পারবে কিনা"

আমি তরুণীকে ভরসা যোগালাম "আমি তো জানতাম যে এই বিয়ের পাত্র নাকি অসাধ্য সাধন করতে পারেন  আর আপনি ভাবছেন এই জায়গা দিতে যাতে পারবেন না "

তরুণী ভ্রূকুটি করলেন "মানেকি বলতে চাইছেন?"

আমি মোক্ষম দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরলাম "আজকাল ভালো ক্যাটারের এর জন্য - মাস আগে বলতে হয়ভালো   বিয়ে বাড়ি পেতে গেলে এক দেড় বছর আগে নাম লেখাতে হয়আর ভালো পাত্রী পাওয়া তো বহু বছরের সাধনার কাজ  কিন্তু শুনেছি উনি নাকি এই সমস্ত কঠিন কাজ এক বছরের মধ্যেই করে ফেলেছেনতাই বলছিলাম " 

দেখলাম কথাটা তরুণীর মনে ধরেছে  "ভালোই তো ডায়ালগবাজি পারেন দেখছিবলে মুচকি হেসে চলে গেলেন। মনে হলো যে উনি নিশ্চই ঠান্ডা হয়েছেন এতক্ষনেতবুও সাবধানের মার্ নেই আমি তাই ওনাকে ঠান্ডা রাখার জন্য আরো দুটো এক্সট্রা আইসক্রিম  দিয়ে এলাম , বিয়েরদিনে বরযাত্রীকে   চটিয়ে কাজ নেই।

পরের কিছু ঘন্টা নির্বিঘ্নেই কাটলো।  বিপত্তি ঘটলো বাসর ঘরে  আমাকে দেখে সেই তরুণী চমকে গেলেন "আপনি বাসরঘরে কি করছেনআপনার কাজ তো হয়ে গেছে নাকি?"

আমিও একটু ঘাবড়ে গেলামআমার কাছে যেটা সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজঅর্থাৎ ভুরিভোজসেটা তো এখুনি   শেষ করেই এসেছি  । তরুণী কি করে সেটা বুঝে গেলেন? আমি একটু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম যে "বাসর ঘরে একটু গল্প গুজব করতে   এলাম সবার সঙ্গে, এই আর কি"

তরুণী  মুচকি হেসে বললেন "আপনি তো খুবই কর্তব্যপরায়ণ ইভেন্ট ম্যানেজার দেখছিআজ অবধি কোনো    ইভেন্ট ম্যানেজার কে বাসরঘর সামলাতে দেখিনি"

আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে জানালাম যে আমার কোনো কিছু ম্যানেজ বা সামলানোর ক্ষমতা খুবই সীমিত , আমি   তাই পাত্রীর বন্ধু হিসেবেই এসেছি 

তরুণী দেখি চমকে গেলেন, "তাহলে স্যুট পড়েন নি কেন?"

সত্যি কথা বলতে আমার আমেরিকা থেকে কলকাতায় ফিরলে সবসময় গরম লাগতোতাই জিন্স টিশার্ট পরেই   এসেছিলাম বিয়েতে , স্বীকার করে ফেললাম "খুবই ভুল হয়ে গেছে জানি স্যুট না পড়াটাআসলে স্যুট পড়লে তো খুব গরম লাগে , তাই "

তরুণীও  একটু লজ্জিত হয়েই স্বীকার করলেন যে আমাকে ইভেন্ট ম্যানেজার ভেবে উনি এতক্ষন কথা বলেছিলেনকিন্তু সঙ্গে এটাও জানাতে ভুললেন না যে আমার পোশাক আশাকের জন্যই এই বিপত্তি। "ইভেন্ট ম্যানেজার সেজে ডায়ালগবাজি ছাড়া কি করা হয়"  উনি জানতে চাইলেন।  আমি সত্যিটাই বললাম "ছোট একটা গ্রাম এর ব্যাঙ্ক  কাজ করি"

তরুণী একটু ক্ষুন্ন স্বরে প্রশ্ন করলেন "মানে আপনি কি টাকা গোনার কাজ করেন?"

আমিও মেনে নিলাম "হ্যাঅনেকটা  ঐধরণের কাজই করি"

তরুণী আমায় আস্বস্ত করলেন যে নিষ্ঠার সঙ্গে করলে সব কাজই সমান ভালো ।  আমিও এককথায় এই সত্যটি  স্বীকার করে নিয়েছিলাম।

এই ঘটনার মাসখানেক পরে সেই তরুণী ফেইসবুক থেকে আমায় খুঁজে বের করে আবার প্রচুর ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন  আমি যে আমেরিকায় থাকিপেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারএইসব না বলে ওনাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলায় উনি যে অত্যন্ত রাগ করেছেন সেটা জানাতে ভুললেন না  আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওনাকে বোঝানোরগ্রাম জিনিষটা যে শুধু ভারতেই থাকেআমেরিকায় থাকে নাএই ধারণা নিয়ে উনি যদি ভুল বোঝেন তো আমি কি করব। আমি তো সত্যি আমেরিকার একটা গ্রামেই চাকরি করি 

তরুণী আরো অভিযোগ করলেন -আমার পেশা নিয়ে মিথ্যে বলা উচিত হয়নিওনার এতে খুবই অভিমান হয়েছে  আমি অবশ্য বারবার ওনাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম যে সত্যি আমার কাজ টাকা গোনাব্যাঙ্কের কোন   ব্রাঞ্চ  কত টাকার লেনদেন হচ্ছেকোন ক্রেডিট কার্ডে কত টাকার কেনাবেচা হচ্ছেএইসব  হিসেব করার সফটওয়্যার প্রোগ্রাম বানাই।  উনি যদি ভাবেন ব্যাঙ্ক কর্মচারী মানেই ক্লার্কতাহলে আমি কি করবোব্যাংকে ক্লার্ক থেকে শুরু করে ম্যানেজারপ্রেসিডেন্ট , সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সবাই কাজ করে একথাও বলেছিলাম  তাও ওনার অভিমান কমেনি 

  

 

উপসংহার : এই তিন দশক ধরে দেখলামকেউ ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে বাঙালি সেজে বিয়ে করেকেউ আবার স্যুট   পড়ে সাহেব সেজে বিয়ে করে।  কখনো তত্ব সাইকেল রিক্সায় যায়কখনো আবার তত্ব outsource হয়ে যায়। যুগের ধর্মই পরিবর্তন , আগামী দশকে হয়তো আরো পরিবর্তন আসবে  হয়তো এরপরে বিয়ে অনলাইন হবেহয়তো শুভদৃষ্টি facetime  হবেহয়তো অতিথিরা জুম্ মিটিং  নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করবে।  যে তিনটি বিয়ের কথা বললামসেই তিন জোড়া দম্পতি আজও সুখে শান্তিতে সংসার করছে।  সুতরাং আশা করা যায় যে আগামী দিনের দম্পতিরাও সুখেই থাকবেনসে বিবাহ অনুষ্ঠানের আড়ম্বর বাড়ুক বা   কমুক যাই হোক না কেন 

বিদেশে বাণী বন্দনা

  প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় ...