Wednesday, February 10, 2021

বিদেশে বাণী বন্দনা

 


প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় যারা কোনোদিন সরস্বতী  পুজোর প্যান্ডেল সাজায়নি, নববর্ষের প্রভাত ফেরি তে যায়নি, যারা দুর্গাপূজায় অঞ্জলি না দিয়ে শুধু মাত্র নতুন জামা পরে ফ্যাশন করেছে , তারাও আমেরিকায়  এসে বিশাল সংস্কৃতি মনস্ক হয়ে যায় । 

আমিও এইরকম এক বাঙালি । কুড়ি পঁচিশটা বাঙালি পরিবার মিলিয়ে সরস্বতী পুজো করবো ঠিক করেছি। তাই এক শনিবার সকালে আমার সহকারী তপন কে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম  আদিত্য রায় এর বাড়ি । আদিত্য দা আমাদের পরিচিত মহলের সবচেয়ে সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ, যাকে কেউ কেউ সবচেয়ে আঁতেলও বলে থাকে।  

আদিত্যদা আমাদের পুজোর পরিকল্পনা শুনে  প্রথমেই বাউন্সার ঠুকে দিলেন
"আমেরিকার বাঙালিদের সরস্বতী পুজো করার উদ্দেশ্য কি বল"

আমি তৈরী হয়েই এসেছিলাম, বললাম যে দোলযাত্রা, স্বাধীনতা দিবস বা দীপাবলি ও তো বাকিরা করে, তাহলে সরস্বতী পুজোর বাদ যায় কেন ?
 
আদিত্য দা বক্তব্য শুরু করলেন "প্রথম কথা এটা আঞ্চলিক প্রথা, যা কিনা দোলযাত্রা, স্বাধীনতা দিবস বা দীপাবলির মতো  সারা ভারতে অনুষ্ঠিত হয়না । এটা শুধুমাত্র বাঙালিদের অনুষ্ঠান ।  তাছাড়া এখানে তো আর স্কুল কলেজে সরস্বতী পুজো হয়না, যে ছোটরা দায়িত্ত্ব নিয়ে একটা পুজোর আয়োজন করবে । তাহলে আমরা, এই মাঝবয়েসী সম্প্রদায় কেন বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে সরস্বতী পুজো করবো ?"

 তপন তড়িঘড়ি চেষ্টা শুরু করলো প্রসঙ্গ টা হালকা করার "দেখুন আদিত্য দা, জানেন তো  সরস্বতী পুজো হচ্ছে বাঙালিদের ভ্যালেন্টাইন্স ডে । তাই আমরা  সরস্বতী পুজো করে ছোট বেলার স্কুল জীবনের ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন এর স্মৃতি রোমন্থন করবো ।"

আদিত্য দা  কথাটা উড়িয়ে দিলেন  "ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করতে যেটা সবচেয়ে  বেশি প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রেম , সেটা বেশিরভাগ বাঙালির কপালেই জোটে না । অন্তত স্কুল জীবনে সরস্বতী পুজো করার বয়েসে জোটে না ।"

তপন চমকে গেলো " কি বলছেন? বাঙালিরা স্কুল কলেজ এ প্রেম করে না? আমাদের প্রেম জোটে না ?"

আদিত্যদা হাসলেন "ভেবে দেখ, যদি বেশিরভাগ বাঙালিদের প্রেম জুটতো তাহলে নীলাঞ্জনা, বেলা বোস কিংবা সুকান্ত জাতীয় বিরহের গান এতো  জনপ্রিয় হতো না । বাঙালিদের নিয়ে বলা হয় জন্ম থেকে সেন্টু খেয়ে শহীদ শহীদ ভঙ্গি, গুলির আগেই সারেন্ডার আর প্রেমের আগেই লেঙ্গি।  তাই বাঙালিদের বেশিরভাগ ক্রাশ গুলো প্রেমে পরিণত হওয়ার আগেই crushed হয়ে যায়।  ভ্যালেন্টাইন্স ডে অবধি গড়ায় না ব্যাপারটা । "

একটা লম্বা নিঃশাস নিয়ে বক্তব্য শেষ করলেন "বুঝলি তো, সরস্বতীপুজোর নাম করে আমরা ছোটবেলার ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করার স্মৃতি রোমন্থন করছি, এই যুক্তি টা দু -পাঁচ জনের জন্য হতে পারে, সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য হতে পারে না।"

এবারে আমি ম্যানেজ দেয়ার চেষ্টা করলাম "শুধু সরস্বতী পুজো কেন, আমরা বাঙালিরা যেকোনো পুজো বা যেকোনো অনুষ্ঠান  করি সেলফি তোলার জন্য । অনুষ্ঠান মানেই সেখানে প্রচুর সুন্দরীর সমাগম হবে, এবং তারপরে সেই সুন্দরীদের  সুন্দর সুন্দর সেলফি স্মার্ট ফোন এর মাধ্যমে ছড়িয়ে যাবে ফেইসবুক আর ইনস্টাগ্রামে , এবং ক্রমশ সেখান থেকে  ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শহর আর বিভিন্ন গ্রামে । ধরুন না আমরা সেলফি তোলার কিছু সুযোগ করে দিচ্ছি এই অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে, আর সেই সঙ্গে পুজো হচ্ছে, খিচুড়ি খাওয়াও হচ্ছে "

আদিত্য দা তবুও অনড় " আজকের যুগের ধর্ম যাই হোক না কেন ,মনে রাখতে হবে যে একটা সময় ছিল যখন ফেইসবুক ছিল না, স্মার্টফোন ছিল না, সেলফি ও ছিল না,  কিন্তু তখনও সরস্বতী পুজো হতো । তাই শুধুমাত্র লোক দেখানো ছবি তোলা নয়, সরস্বতী পুজোর এই কালজয়ী প্রথার পেছনে নিশ্চই আরো গভীর কোনো কারণ আছে । ভেবেছো কি সেই কারণ?  কেন আমরা  বাঙালিরা সরস্বতী পুজো করি ?"

তপন আবার আইডিয়া দিলো , "দেখুন আদিত্য দা ,  সরস্বতী পুজো হয় মাঘ মাসে , মাঘ মাসের পরেই আসে ফাল্গুন মাস আর সেই সঙ্গে আসে অ্যানুয়াল পরীক্ষা কিংবা বোর্ড  এর পরীক্ষা । মা সরস্বতী বিদ্যার দেবী । ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্ট হোক কিংবা লাস্ট, জীবন প্রেমপূর্ণ হোক বা প্রেমশূন্য , পরীক্ষার আগে মা সরস্বতীর আশীর্বাদ নিতে কেউ পিছপা হয় না । সেইজন্যই  তো ছোটবেলায় আমরাও  সবাই  'বিদ্যাং দেহি নমস্তুতে' বলে পুষ্পাঞ্জলি দিতে যেতাম ।"

বিদ্যার দেবী প্রসন্ন হয়েছিলেন বলেই আজকাল বিভিন্ন দেশে এতো প্রবাসী বাঙালি দেখা যায় । কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ হয়তো উচ্চপদস্থ চাকরির জন্যই বিদেশে আবির্ভূত হয়েছেন । আর দেবী সরস্বতীর অবদান ভুলতে পারেননি বলেই আজও দেবীর পুজো করেন । এই ব্যাখ্যা টা আদিত্য রায়ের মনঃপুত হবার কথা।  
কিন্তু আদিত্য দা তবুও আরেকটি বাঁকা প্রশ্ন করলেন "তার মানে কি বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতি শিক্ষিত হতে চায় না? অন্য কোনো জাতি কি পড়াশোনা করে না? তারা কেন এতো মেতে ওঠে না সরস্বতী পুজো নিয়ে?"

সত্যি এবার আর উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আদিত্য দা নিজেই বুঝিয়ে  দিলেন ।
ভারতের কিছু রাজ্য আছে, যেখানে লোকজন বলেন "ছেলেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে যাতে বিদেশে গিয়ে ডলার কামাতে পারে"
কিছু  লোকজন বলেন "মেয়েকে MBA  পড়াবো যাতে Mumbai তে ফ্লাট কিনতে পারে" ।
কেউ কেউ বলেন " আইএএস করতে হবে, তবেই ডজন খানেক লোক এর সেলাম পাওয়া যাবে" । যারা শিক্ষা বা বিদ্যা কে উপার্জনের মার্গ ভাবেন, তারা সরস্বতীপূজা না করে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনাই তো করবেন।

তপন উত্তেজিত হয়ে উঠলো, "এগুলো দার্শনিক কথাবার্তা। টাকা উপার্জন করা, কিংবা খ্যাতি উপার্জন করা কি ভুল?"

আদিত্য দা বললেন " কখনোই নয়। এইজন্যই আমরা বাঙালিরা ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো আর সরস্বতী পুজো, দুটোই করি। জীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতি যেরকম দরকার, সেইরকম সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তিও দরকার। কিন্তু এই দুটো দরকারকেই আলাদা করে গুরুত্ব দেয়া উচিত, একটা দিয়ে অন্যটাকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত না। "

আদিত্য দা র বক্তব্য টা বুঝলাম। হয়তো এইজন্যই বাঙালিরা শিক্ষালাভ কে অর্থ লাভ বা প্রতিপত্তিলাভ এর মার্গ ভাবেন না, শিক্ষা কে শুধুমাত্র শিক্ষার মতো করেই সম্মান জানান । অন্তত আমাদের ছোটবেলায় বাঙালি ঘরে ঘরে তাই হতো। সত্যি তো, সরস্বতী পুজোর দিন প্রার্থনা করার সময়ে আমরা কখনো বলিনি যে "মা, এমন বিদ্যা দাও মা, যাতে ডলার কমাতে পারি, এমন বিদ্যা দাও মা যে মুম্বাই এর মধ্যভাগে ফ্লাট কিনতে পারি" ।  

তখন বাঙালিদের ঘরে এক দেয়ালে পাশাপাশি ঠাঁই পেত রবিঠাকুর আর বিদ্যাসাগর  মশাই এর ছবি । আমরা ওনাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য কে গুরুত্ত্ব দিতাম না, শ্রদ্ধা জানাতাম ওনাদের শিক্ষা আর সংস্কৃতি কে  । যখন কোনো স্কুল এর হেডমাস্টার ফতুয়া লুঙ্গি আর চপ্পল পরে  বাজার করতে যেতেন, পাড়ার দোকানদার বা বাচ্ছারা তাঁকে প্রণাম জানাতো । আদিত্য দা র প্রশ্নের উত্তর টা পেয়ে গেলাম।

"আপনি জানতে চাইছিলেন না, যে কেন আমরা বিদেশে বসে সরস্বতী পুজো করবো? বাঙালিদের যে একটা প্রাচীন ঐতিহ্য - শিক্ষা বা সংস্কৃতির জন্য সম্মান - সেই ঐতিহ্যটা টিকিয়ে রাখার জন্যই আমরা সরস্বতী পুজো করবো।"

আদিত্য দা খুশি হলেন "শাবাশ ! যতদিন বাঙালিদের মনে শিক্ষা বা সংস্কৃতির জন্য এই সম্মানটা থাকবে, ততদিন বাঙালিরা সরস্বতীপুজো চালিয়ে যাবে, সে প্রবাসী বাঙালি হোক বা বঙ্গবাসী । "
 তারপরে মুচকি হেসে বললেন "ভুললে চলবে না,  একজন বাঙালি বলেছেন যে টাকাপয়সা এমন একটা জিনিস, শিক্ষিত মানুষের হাতে পড়লে তার নাম 'অর্থ' , আর অশিক্ষিতের হাতে পড়লেই অনর্থ! "

No comments:

Post a Comment

বিদেশে বাণী বন্দনা

  প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় ...