Sunday, November 18, 2018

বিমানবন্দরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট



পর্যটকদের প্রিয় শহর পোর্টল্যান্ড  আমেরিকার উত্তর পূর্ব অঞ্চলে মেইন রাজ্যে অবস্থিত এই শহর টি একদিকে সামুদ্রিক খাবার , অন্য দিকে Acadia  ন্যাশনাল পার্কের দ্বারদেশ হিসেবে পরিচিত   তাই হঠাৎ যখন অফিসের কাজ নিয়ে দুদিন পোর্টল্যান্ড যেতে হবে শুনলাম , মনে মনে অত্যন্ত পুলকিত হয়ে উঠলাম দুদিন ধরে সামুদ্রিক খাবার খাবো আর সেই সঙ্গে পাহাড় সমুদ্রের ধারে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলবো ভেবেই "সুদূরের পিয়াসী " মনটা বেশ "চঞ্চল" হয়ে উঠলো


প্রথম দুদিন মনের আনন্দে বিভিন্ন প্রকার এর গলদা চিংড়ি আর কাঁকড়া খেয়ে কাটালাম পোর্টল্যান্ড অফিসের লোকজন দেখলাম খুবই আন্তরিক প্রথম দেখাতেই ওনারা বিখ্যাত সব স্থানীয় খাবার আর রেস্তোরার সন্ধান দিলেন তারপর থেকে নিয়মিত ভাবে ওনারা খোঁজ নিতেন সেই সব খাবার খেয়েছি কিনা যদিও ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা টি সফল হলো না প্রথম দিন ভীষণ ঠান্ডা এবং দ্বিতীয় দিন থেকে বৃষ্টি যোগ হওয়ায় আমি হোটেল এর নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছিলাম   


এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে দেখলাম ঝোড়ো আবহাওয়া , সঙ্গে বৃষ্টি । ভাড়া গাড়িতে তেল ভরার জন্য নামতে হলো , আর মুহূর্তে ভিজে গেলাম ।  ওই  ঠান্ডাতে ভেজা জ্যাকেট টুপি আর সোয়েটার পড়ে আধ ঘন্টা গাড়ি চালানোটা মনে হয়েছিল চরম দুর্গতি । কিন্তু পরে  বুঝেছিলাম যে আগামী কিছু ঘন্টার তুলনায় এই আধ  ঘন্টা কিছুই নয় । এয়ারপোর্ট ঢুকে  মনে হলো যেন কোনো মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করছি  ।চারদিকে একটা গা ছমছম করাঅন্ধকার । গাড়ি  ফেরত  দেয়ার  কাউন্টারে  গিয়ে শুনলাম যে  একটা ট্রাক নাকি ঝড়ের মধ্যে  দিকভ্রষ্ট  হয়ে  একটা  ইলেকট্রিক  পোলে  ধাক্কা  মেরেছে  । তার  ফলস্বরূপ  সমস্ত  এলাকায়  বিদ্যুৎ  বিপর্যয়  ঘটেছে । 


ছোটবেলায় কলকাতায় বড়ো হয়েছি লোডশেডিং এর অনেক স্মৃতি আছে  ছোটবেলা থেকেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট মানেই ছিল পড়াশোনা থেকে ছুটি , বারান্দা বা ছাদ বসে রাতের সৌন্দর্য্য বা চাঁদের আলো দেখে মুগ্ধ হওয়া কিন্তু দেখলাম এয়ারপোর্ট বিদ্যুৎ বিভ্রাট মোটেই এরকম সুখকর কিছু নয় ভাড়া গাড়ি ফেরত দেয়ার সময় জানতে পারলাম যে কম্পিউটার চলছে না , তাই ওনারা আমায় রশিদ দিতে পারবেন না কোম্পানির  কাজে এসেছি তাই রশিদ ছাড়া টাকা পাবো না ভেবে মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো কাউন্টার এর ভদ্রলোক জানালেন যে আমি যদি কারেন্ট আসা অবধি অপেক্ষা করি  তাহলে অতি আনন্দের সঙ্গেই উনি আমায় রশিদ দেবেন ভেবে দেখলাম যে রশিদ এর জন্য প্লেন ছেড়ে দেয়া যায় না   তাই রশিদ এর মায়া   ত্যাগ করে চেক ইন করতে অগ্রসর হলাম


চেক ইন কাউন্টার দেখি একই অবস্থা কোনো কম্পিউটার কাজ হচ্ছে না  এমার্জেন্সি সিস্টেমে শুধু এয়ারপোর্ট এর কনভেয়র বেল্ট , কন্ট্রোল রুম কন্ট্রোল টাওয়ার এর লাইট ইত্যাদি চলছে আর সেই সঙ্গে গুটিকতক সিলিং এর লাইট জ্বলছে আজকাল আমরা যেরকম মেশিন ক্রেডিট কার্ড বা নাম দিয়ে বোর্ডিং পাস প্রিন্ট করি সেই রাস্তা বন্ধ লোকজন এক এক করে কাউন্টার যাচ্ছে , কাউন্টার এর মহিলা ফোন করে হেড অফিস থেকে জেনে নিচ্ছেন সেই যাত্রীর কত নম্বর সিট তারপরে সাদা কাগজে সেই  যাত্রীর নাম আর সিট নম্বর লিখে মহিলা সই করে স্ট্যাম্প মারছেন একদম যেন ত্রিশ বছর আগের অবস্থা বলাই বাহুল্য যে এই  চেক ইন পদ্ধতি   গুন্ বেশি সময় নিচ্ছে  তাই সমস্ত এয়ারপোর্টেই প্রচুর ভীড় , প্রচুর লাইন , আর সেই সঙ্গে লোকজনের প্রচুর বিরক্তি  বিরক্তির আরেকটা কারণ এমার্জেন্সি পাওয়ার এ এসি মেশিন চলছে না । তাই যাত্রীগণ অনেকেই এই গুমোট আবহাওয়ায় ঘামছেন, এবং আরো বিরক্ত হচ্ছেন । চেক ইন কাউন্টার এর সংকীর্ণ জায়গায় প্রচুর যাত্রীর এই ঘর্মাক্ত পরিস্থিতি, পুরো জায়গাটাকে আরো  বিরক্তিকর করে তুলছে । 


সিকিউরিটি চেক এর অবস্থাও দেখলাম বিশেষ ভালো নয় | পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স স্ক্যান করে সমস্ত ঠিকুজি কুষ্ঠি বার করে ফেলা মেশিন গুলো আজ অচল । একজন বৃদ্ধ সিকিউরিটি অফিসার দুতিন রকম নীল বেগুনি আলোর টর্চ নিয়ে সবার পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করছেন । ওনার মুখে গর্ব ও তৃপ্তি মিশ্রিত অভিব্যক্তি । আধুনিক যুগের মেশিন এর সঙ্গে আধুনিক যুগের সিকিউরিটি অফিসার গণও এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে অচল হয়ে গেছেন । সবাই দল বেঁধে ওই বৃদ্ধ সিকিউরিটি অফিসার এর পেছনে দাঁড়িয়ে শিখছেন কিভাবে মেশিন ছাড়াও জাল পাসপোর্ট বা জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ধরা যায় |


যাই হোক প্রায় দুঘন্টা ভেজা জামাকাপড় পরে ছিলাম সিকিউরিটি চেক এর পরে ভাবলাম বাথরুম কাপড় বদলে নেবো সেখানেও দেখি ঘোর বিপদ  বাথরুমের অল্প আলোতে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া এড়াতে কতৃপক্ষ বেশিরভাগ বাথরুম বন্ধ রেখেছেন   শুধুমাত্র একটি বাথরুম এমার্জেন্সি আলোতে উদ্ভাসিত   বলাইবাহুল্য সেখানে বিশাল  লাইন হতাশ হয়ে এয়ারপোর্টের একটা কোনায় গিয়ে ব্যাগ খুলে পোশাক বদল করা শুরু করলাম হঠাৎ করে সেই অন্ধকারের মধ্যেও দুজন এয়ারপোর্ট কর্মী এসে আমায় শাসিয়ে গেলেন যে আমি যেন পাবলিক জায়গায় এরকম অসভ্যতা না করি আমি বিনীত হয়ে  জানালাম যে আমি শুধুমাত্র পাবলিক জায়গায় নিউমোনিয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম ওনারা জবাবে আমাকে কফি খাবার উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন  |


এমনিতে আমি খুব একটা কফি ভক্ত নই , কিন্তু এই প্রস্তাবটা ভালোই লাগলো এমনিতেই ঠান্ডা লাগছিল , পেটের আনাচেকানাচে খিদেরা উঁকি দিচ্ছিলো আমার :৩০ এর ফ্লাইট শুনলাম :০০ ছাড়বে এয়ারপোর্ট এর একটা রেস্টুরেন্ট ঢুকে পড়লাম রেস্টুরেন্ট এর  সুন্দরী একগাল হেসে এমনভাবে অভ্যর্থনা  জানালেন যেন এতদিন উনি আমারি পথ চেয়ে বসে ছিলেনআমি ওনাকে অনুরোধ করলাম অবিলম্বে গলদাচিংড়ির সূপ আর কাঁকড়ার বড়া দিয়ে যেতে | উনি দুঃখের সঙ্গে জানালেন যে বৈদ্যুতিক  চুল্লি বন্ধ থাকায় ওনারা কিছুই রান্না করতে পারবেন না  বাধ্য হয়ে কফি চা ইত্যাদির খোঁজ করলামবলাই বাহুল্য , আবার নিরাশ হলাম | মরিয়া হয়ে আমি আমার দুর্দশার  কথা বিশারভাবে ব্যক্ত করলাম । উনি আমায় ব্র্যান্ডি খাবার  পরামর্শ দিলেন - কারণ মদ্যপান করতে বৈদ্যুতিক সহযোগিতা লাগে না । আমি একটু দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলাম , ব্র্যান্ডি খেয়ে ফ্লাইট এ ওঠা কি ঠিক হবে? যদি নেশা হয়ে যায়? মহিলা আমায় আশ্বাস দিলেন যে পোর্টল্যান্ড এ মানুষদের তিন রকম এর নেশা হয়। কারোর হয় সামুদ্রিক খাবারের নেশা, কারোর হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নেশা । কেউকেউ আবার পোর্টল্যান্ডের সুন্দরী মহিলাদের কটাক্ষের নেশায় নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ।  কিন্তু পোর্টল্যান্ড শহরে কাউকে মদ্যপান করে নেশাছন্ন হতে কখনো উনি শোনেন নি । আমার মুখের সন্দিহান ভাব দেখে ওনার মনে হলো আমি হয়তো কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি । তাই শেষমেশ উনি এটাও বললেন যে নেশা হলেও চিন্তার কোনো কারণ নেই, কারণ প্লেন চালানোর জন্য পাইলট আছে, আমাকে প্লেন চালাতে হবে না । ব্র্যান্ডি বা যেকোনো ধরণের মদ্যপান এর অর্ডার এর সঙ্গে যে এক প্লেট বাদাম ভাজা ফ্রি তে দেয়া হয়, একথাও উনি জানাতে ভুললেন না । এতক্ষনে ওনার চেষ্টা সফল হলো । আমরা হাজার হলেও ভারতীয় কনসিউমার ।যেকোনো জিনিস এ ফ্রি অফার থাকলে সেগুলো আমরা ছাড়তে পারিনা ।অবিলম্বে ব্র্যান্ডি অর্ডার করে পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে দিলাম । কিন্তু ক্রেডিট কার্ড দেখে সুন্দরীর মুখভঙ্গি অনেকটা কলকাতার  বাস কন্ডাক্টরদের  মতো হয়ে গেলো । ক্রেডিট কার্ড এর মেশিন  ও যে অচল । খুচরো ক্যাশ  ছাড়া গতি নেই । কিন্তু যাই হোক এই মহিলার কন্ডাক্ট বাস কন্ডাক্টরদের থেকে ভালোই  ছিল । উনি দয়া পরবশতঃ  আমাকে ফ্রি বাদাম ভাজা থেকে বঞ্চিত করেন নি । সঙ্গে কফি মেশিন থেকে প্রায় ঠান্ডা ঈষদুষ্ণ এক  কাপ কফি ও খাইয়েছিলেন ।     


শুনেছিলাম বাদাম খেলে নাকি বুদ্ধি বাড়ে । দেখলাম, বাদাম ভাজা খেয়ে মনে নানারকম সুবুদ্ধির উদয় হলো । প্রথমে মনে হলো গিন্নি কে অন্তত খবর দেয়া উচিত যে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে । ঐদিন আবার মহাকালী পুজো , ভেবেছিলাম সপরিবারে ও সবান্ধবে মাঝরাতে কালীমন্দির এ গিয়ে পুজো দেখবো । কিন্তু এয়ারপোর্ট এ যা অবস্থা দেখলাম, তাতে হয়তো পৌঁছাতে দেরি হবে এই আভাস গিন্নিকে জানিয়ে রাখলাম । ইতিমধ্যে সেই বন্ধুরাও ফোন এ যোগাযোগ করা শুরু করে দিয়েছে , তাদের সবাইকেও জানাতে হলো আমার এই দুর্দশার কথা । এইসব দুর্দশার খবর দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম নতুন আরেকটি দুর্দশা ঘনিয়ে এসেছে । মোবাইল ফোন এ মাত্র কুড়ি % চার্জ আছে । সমস্ত এয়ারপোর্টেই আজকাল ফোন চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা থাকে বলে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম । কে জানতো যে এয়ারপোর্ট এইরকম বিদ্যুৎ বিভ্রাট এর শিকার হবে, আর আমাকে মোবাইলহীনতার আশংকায় ভুগতে হবে !!



ক্রমশ আসে পাশে তাকিয়ে "বিগ পিকচার" টা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করলাম । এমার্জেন্সি পাওয়ার এ কন্ট্রোল রুম , কন্ট্রোল টাওয়ার ইত্যাদি তো চলছে , তাহলে সব ফ্লাইট এ এতো দেরি কেন ? এতো ভীড় কেন ? যা বুঝলাম, এমার্জেন্সি পাওয়ার এ jetway (যেই টিউব গুলো দিয়ে যাত্রীরা হেটে হেটে এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থেকে প্লেন এর পেটের ভেতর ঢুকে পরে  ) গুলো চলছে না । তাই যাত্রীদেরকে সিঁড়ি দিয়ে হেটে টার্মিনাল থেকে মাটিতে নামতে হচ্ছে , এবং তারপরে সিঁড়ি দিয়ে হেটে প্লেন এ উঠতে হচ্ছে । ঠিক যেমন আমরা কুড়ি তিরিশ বছর আগের সিনেমা বা ছবিতে দেখতাম । টার্মিনাল এর ১৬ টা গেট এর মধ্যে মাত্র দুটো গেট এই সিঁড়ি আছে, তাই সমস্ত ফ্লাইট এই দুটো গেট দিয়েই ছাড়ছে । সেইজন্যই এতো দেরি । বোর্ড এর দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করলাম যে আমার ফ্লাইট টা এতক্ষনে পিছিয়ে ৭:৩০ হয়ে গিয়েছে, এবং ও দেখলাম যে দুপুর ৩:০০ এর ফিলাডেলফিয়ার  ফ্লাইট টা এই সন্ধ্যে ৬:৩০ টা নাগাদ ছাড়বে । ভাবলাম চেষ্টা করে দেখা যাক আগের ফ্লাইট এ কোনো সিট ফাঁকা পাওয়া যায় কিনা , তাহলে ১ ঘন্টা আগেই বাড়ি যেতে পারবো । একটা আঠেরো মিনিটের ফোন কল , পঁচিশ ডলার আর ফোনের বাকি চার্জ এর পুরোটা খরচ করে ১ ঘন্টা আগের ফ্লাইট এ সিট বুক করে নিলাম । এবং নিজের এই বুদ্ধিতে নিজেই চমৎকৃত হয়ে গেলাম । 


ইতিমধ্যে আরো কিছু সময় কেটে গেলো । আমার মোবাইল ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে । এর মধ্যে ৬:৩০ আর ৭:৩০ এর ফ্লাইটগুলো যথা ক্রমে পিছিয়ে ৭:০০ আর ৮:০০ হয়ে গিয়েছে । জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে ৬:৩০ এর ফ্লাইট টি অন্ধকার রানওয়ে তে ল্যান্ড করতে গিয়ে বেকায়দায় গুতো খেয়ে সামনের চাকাটি ফাটিয়ে ফেলেছেন । চাকা বদল করার জন্য এই তিরিশ মিনিটের বাড়তি বিলম্ব । যাই হোক, এই ঠান্ডা র মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, আরেকদফা বৃষ্টিতে ভিজে প্লেন এ গিয়ে চড়লাম । সমস্ত যাত্রীরা বসলেন, দরজা বন্ধ হলো, কিন্তু প্লেন আর এগোয় না । মিনিট কুড়ি পরে ঘোষণা হলো যে আমাদের আবার এয়ারপোর্ট টার্মিনাল এ ফিরে যেতে হবে । চাকার সঙ্গে এক্সেলে আরো কিছু ক্ষতি হয়েছে, যেজন্য প্লেনটি মেরামত না করে উড়ান এ যেতে পারবে না । সমস্ত যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে গজ গজ করতে করতে টার্মিনাল এ ফিরে এলেন । আমার বিরক্তির কারণ আরো বেশি ছিল, কারণ এই দুবার বৃষ্টি ভিজে এই ফ্লাইট এ ওঠানামা করার জন্য আমায় আঠেরো মিনিটের ফোন কল , পঁচিশ ডলার আর মোবাইল ফোনের চার্জ এর পুরোটা খরচ করতে হয়েছিল ।


এয়ারপোর্ট কতৃপক্ষ এবার জানালেন যে এই বিকল হয়ে যাওয়া ফ্লাইটের সমস্ত যাত্রীরাও এক ঘন্টা পরের ফ্লাইটেই ফিরবেন । সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে । কিন্তু এই দুটি ফ্লাইটের যাত্রীদের একসঙ্গে নেয়ার জন্য আরো বড় বিমানের প্রয়োজন । তাই আমাদের পরিত্রানের জন্য ওয়াশিংটন থেকে আরেকটি বড়োসড়ো বিমানকে উড়িয়ে আনা হচ্ছে । এই কারণে আমাদের ৮:০০ টার ফ্লাইট এবার ৮:৩০ এ ছাড়বে । যাত্রীদের হতাশা ও বিরক্তি দূর করতে বিকল হয়ে যাওয়া বিমানের সমস্ত খাদ্য (যেমন চিপস, কোল্ড ড্রিংক আর জুস ) বিলিয়ে দেয়া হলো যাত্রীদের মধ্যে । চার প্যাকেট চিপস হজম করে সত্যি একটু চাঙ্গা বোধ করলাম । মানসিক অবস্থার সঙ্গে দেখলাম ভাগ্য কিছুটা উন্নতি হলো । নতুন  বিমান নির্ধারিত সময়ে এসে পৌছালো । আমিও একটি খুব লোভনীয় আসন লাভ করলাম - কারণ -  আমার পাশের সিট এর সহযাত্রিণী একটি পাওয়ার ব্যাঙ্ক নিয়ে ঘুরছিলেন ।  প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ওনার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিয়ে আমি ওনার পাওয়ার ব্যাঙ্ক এর সাহায্যে আমার মৃত মোবাইলকে আবার পুনর্জন্ম দান করলাম ।


নির্ধারিত দেড় ঘন্টার জায়গায় আমাদের আড়াই ঘন্টা লাগলো ফিলাডেলফিয়া পৌঁছাতে ।  শুনলাম যে ওয়াশিংটন থেকে আসার পথে নাকি ঝোড়ো আবহাওয়ায় এই বিমান এর একটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল । তাই আমাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পাইলট সাহেব একটি ইঞ্জিন এর সাহায্যেই আমাদের উড়িয়ে এনেছেন । তাই একটু ধীর গতিতে উনি বিমান উড়িয়েছেন । না না , আমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না । কারণ দুটি ইঞ্জিন বিকল হলেও নাকি অক্সিলারি ইঞ্জিনের এর সাহায্যে বিমান যেকোনো নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট এ নামতে পারে । তাই আমরা খুবই নিরাপদেই এসে পৌঁছেছি, আমাদের বিন্দুমাত্র বিপদের আশংকা ছিল না । মনে মনে ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ  দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোলাম, এবং বাড়ির দিকে রওনা হলাম ।


প্রায় ৪ ঘন্টা কোনো রকম ফোন এর সংযোগ না থাকায় গিন্নি খুবই উৎকণ্ঠায় ছিলেন । ওনাকে ফোন করে আস্বস্ত করলাম । বলাই বাহুল্য যে সেই রাতে আর মন্দিরে গিয়ে কালীপুজো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি । আমার কিছু বন্ধুর ধারণা, আমি মহা গুলবাজ, আমার কোনো কথাতেই ভরসা করা যায়না । আমি মন্দির এ পুজো দেখবো না বলে এরকম একটা মনগড়া গল্প তৈরী করেছিলাম । আবার কিছু বন্ধুর ধারণা যে আমি এতই অলস যে আমি সময়মতো এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে পারিনি আর তাই নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট ধরতে পারিনি , এবং পরের ফ্লাইট এ ফিরেছি । আমেরিকার মতো দেশে যে এয়ারপোর্ট এ বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটা সম্ভব, এটা বিশ্বাস করা সত্যি খুব কঠিন । এই কঠিন কাজটি সহজ করার জন্য আমি সংবাদ মাধ্যমের ওয়েবসাইট এ প্রকাশ হওয়া এই ঘটনার বিবরণটিও আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম  :
 http://www.mainebiz.biz/article/20181107/NEWS0101/181109963/jetport-flights-delayed-after-traffic-accident-knocks-out-power

Wednesday, November 7, 2018

একটি গাঁজাখুরি ভূতুড়ে গল্প


সূর্য
 
প্রদীপ চৌধুরীর মন মেজাজ একেবারেই ভালো নেই আজকাল| থাকার কথাও না| গিন্নির সঙ্গে ঝগড়া করে কারোর কি মন মেজাজ ভালো থাকে? সেই সঙ্গে যদি অফিস এর কাজের সমস্যা দেখা যায়, তাহলে কি আর মাথা ঠান্ডা থাকে কারোর? পুরোনো বংশ গৌরব এর কথা ভেবে অনেক সময়ে নিজের মন কে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন| কিনতু তাতেও সবসময় কাজ হয়না| চৌধুরী বাবুর ঠাকুর্দা আমল অবধি জমিদারি ছিল| এখন জমিদারি নেই, রয়েছে শুধু মুখভর্তি দাড়ি| আর সেই সঙ্গে জমি পেছনে দৌড়ঝাঁপ| না না,  চৌধুরী বাবু নতুন করে জমিদারি করছেন না , উনি এখন এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি তে জমি অধিগ্রহণ বিভাগে কাজ করেন| ফাঁকা জমি, পুকুর, বা পুরোনো বাড়ি ঘর এর খোঁজ দেয়া ওনার কাজ, ওনার কোম্পানি সেখানে মাল্টিস্টোরি ফ্ল্যাট বা শপিং মাল তৈরী করে|


জমিদারি না থাকলেও, জমিদারি মেজাজ টা কিনতু প্রদীপ চৌধুরীর এখনও আছে| সকাল এর চা এর কাপ এর চুমুক থেকে শুরু করে  বিকেল এর সিগারেট এর টান, সব কিছুই একটু আমেজ নিয়ে না করলে ঠিক তৃপ্তি আসেনা| কিনতু জমিদারি  আমেজ টা  মধ্যবিত্ত জীবন আর বজায় রাখা যাচ্ছে না| সকাল এর চা এর প্রথম চুমুক শেষ হওয়ার আগেই গিন্নি তাড়া দেন বাজার করার জন্য| বিকেল এর সিগারেট এর টান এর মধ্যে অফিস এর বস ডাকাডাকি করেন কাজ এর অবস্থা জানার জন্য| অনেক সময়ে একটু আধটু নেশা করে হালকা হওয়ার চেষ্টা করেন, কিনতু সেক্ষেত্রে গিন্নি  এক্কেবারে রণচন্ডি হয়ে বাগড়া দেন| আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়| প্রদীপ বাবু বই এর আলমারিতে এক বোতল স্কচ লুকিয়ে রেখেছিলেন, আর  গিন্নি সক্কাল বেলায় সেটা আবিষ্কার করে বাড়ি মাথায় করে তোলেন| প্রদীপ বাবু বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে স্কচ খাবার মধ্যে একটা জমিদারি ঐতিহ্য আছে, কিনতু লাভ হয়নি| ওনার গিন্নি, রান্না ঘর এর নালায় সেই জমিদারি ঐতিহ্য  বিসর্জন দিয়েছেন|


প্রদীপ বাবু তাই ঠিক করেছেন, এবার থেকে বাড়ির বাইরে বসে নিশ্চিন্তে আমেজ নিয়ে নেশা করে বাড়ি ফিরবেন| মফস্বল এর বাড়ি, কাছেই একটা শ্মশান আছে| অনেকবার যাতায়াত এর পথে দেখেছেন যে একটা বাঁধানো বট গাছ আছে| অনেক সময়ে কেউ না কেউ বসে থাকে| এবার থেকে উনিও ওখানে বসে জমিদারি ঐতিহ্য পালন করে বাড়ি ফিরবেন| কাহাতক এইভাবে অফিস আর সংসার এর চাপ একসঙ্গে সহ্য করা যায়? পরের দিন কালীপুজো, অফিস থেকে সবাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছে| প্রদীপ বাবু সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে গেলেন শ্মশানে| গাছতলায় একটা রুমাল দিয়ে জায়গা রেখে তাড়াতাড়ি করে এক বোতল বিয়ার কিনে নিয়ে ফিরে এলেন| কিনতু এসে দেখলেন মহা ঝামেলা| ওই গাছ তলায় দুজন বসে গপ্পো দিচ্ছে| কাছে গিয়ে দেখলেন একটা মাঝবয়েছি লোক, আরেকটা অল্প বয়েসী ছোকরা|গাঁজার ছিলিম টান দিচ্ছে| ছোকরা আবার ওনার রুমাল এর ওপরেই গাঁজা পাতাগুলো রেখে ছিলিম ভরছে|
 

| প্রদীপ বাবুর আর সহ্য হলো না| উনি গিয়ে বললেন  " কিছু মনে করবেন না , এই জায়গাটা একটু আগে খালি দেখেছিলাম, রুমাল রেখে গেছিলাম" 
ছোকরা টি অম্লান বদনে জবাব দিলো " জায়গাটা খালি দেখেছিলেন আগে, এখন আর জায়গাটাও খালি নেই, রুমাল খালি নেই"
পাশের লোকটি সঙ্গে মন্তব্য করলো, " আরে বাপু জায়গাটা তো তবু  আছে| আরো কিছু সময় পরে এলে হয়তো দেখতে জায়গা টা নেই| একটা ফ্লাট বাড়ি বা শপিং মল হয়ে গেছে|| কি বলিস পচা ?"

প্রদীপ বাবু বিরক্ত হলেন এই দার্শনিক মন্তব্য শুনে| উনি বললেন "ধুর মশাই আমি অত সময় আগে বলিনি , আমি এই কুড়ি মিনিট আগেই এখানে  ছিলাম "
পচা এবারে ঝাঝিয়ে উঠলো "  ছিলেন তো থাকলেই পারতেন , কে মাথার দিব্ব্যি দিয়েছিলো উঠে যেতে ? এটা একটা পাবলিক জায়গা| পাবলিক শ্মশান এর পাবলিক গাছতলা| যার যখন খুশি আসে, যার যখন খুশি যায়| ঠিক বলেছি কিনা বিলটু দা?"
বিলটু দা গাঁজা ছিলিম থেকে মুখ তুলে আবার একটা দার্শনিক মন্তব্য করলেন " পচা ঠিক কথাই  বলেছে, কালচক্রে কিছুই স্থায়ী নয় হে ভাইআজকে যে বর্তমান কালকে সে  ভূত  … "

" ধুর বাবা, এমনিতেই বৌ এর ঝগড়া করে মেজাজ টা বিগড়ে আছে, গাছতলা ফাঁকা জায়গা টাও  নেই যে নেশা করবো, আর আপনারাও উল্টো পাল্টা কথা বলছেন | আমি চললাম, বসুন আপনারা"

"আরে বৌ এর সঙ্গে ঝগড়া কেস নাকি ? নিরিবিলি তে নেশা করতে চাও? আগে বলবে তো ভায়া | এস এস বসো| এই পচা  এক ছিলিম দে তো "

প্রদীপ বাবু নিজের বিয়ার এর বোতল বার করতে করতে বললেন "না না, ছিলিম লাগবে না, আমি নিয়েই এসেছি আমার জিনিস"
পচা নাছোড়বান্দা " এটা স্পেশাল জিনিস| একটা টান দিয়েই দেখুন,  জীবন এর সব দুঃখহ ভুলে যাবেন| মনে হবে আকাশ ভেসে বেড়াচ্ছেন"


এর মধ্যে ঘন্টা খানেক কেটে গেছে| প্রদীপ বাবু গাছতলায় আধশোয়া হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন| মন টা সত্যি হালকা লাগছে| জীবন এর দুঃখ গুলো অতটা আর দুঃখজনক লাগছে না| গাছতলার গাঞ্জাখোর গুলোকেও আর আগের মতো বিরক্তিকর লাগছে না| বিশেষ করে ওই বিলটু দা কে মনে হচ্ছে ওনার সমব্যাথী|

বিলটু দা একবার ঝিমুনি থেকে উঠে প্রশ্ন করলেন " আচ্ছা ভায়া তোমার জীবন এতো টেনশন কিসের, এতো ঝগড়া কেন? একটু খোলসা করে বোলো দেখি"
"কি আর বলবো,  অফিস কাজ এর চাপ| বস রোজ গালাগালি করছে | কালকে কালীপূজার ছুটি| তাই ভাবলাম আজকে একটু নেশা করে হালকা হবো| একবোতল স্কচ লুকিয়ে রেখেছিলাম  | আর গিন্নি সব ফেলে দিলো"

পচা চমকে উঠলো "স্কচ ফেলে দিলো!! কেন?"

" বিয়ে করেছো? করলে বুঝতে কি জিনিষ এই গিন্নি| একটু নেশা করে হালকা হবো, সেটা ওনার সহ্য হয় না |আমার পয়সা দিয়ে কেনা স্কচ   নর্দমা পোকামাকড় আর জীবাণু গুলো নেশা করে ফুর্তি করছে, আর আমি সংসার এর জ্বালায় জ্বলছি |"

" কেন গিন্নিরা খারাপকি? শুনেছি গিন্নি রা যত্ন করে সংসার গুছিয়ে রাখে, ভালো করে খাওয়া দাওয়া করায়, খারাপ কি?"

" খারাপ কি? উনি টিভিতে সিরিয়েল দেখবেন, সেটা ওনার ধর্ম| আর এদিকে  আমি টিভিতে ক্রিকেট বা নিউস দেখলে ধর্মযুদ্ধ বেঁধে যায়|  আমি যদি অফিস থেকে ফিরতে লেট করি ওনার মুখ হাড়ি , কিনতু উনি ঘন্টা শপিং করলে সেটা আমায় হাসি মুখে মেনে নিতে হবে "

"সেই দুঃখ্যে নেশা করেন বুঝি ?"

" করতে পারি কি?  উনি যত খুশি নেশা করবেন, আর আমি একটু নেশা করলেই সেটা বাজে খরচ হয়ে যায় | আমার বেলায় যত দোষ"

"বলেন কি, আপনার গিন্নি নেশা করেন?"

"কেন ফোন এর নেশা কি নেশা নয়? উনি ফোনের বিলে হাজার হাজার  টাকা উড়িয়ে দেন , বান্ধবীদের সঙ্গে বক বক করে আর হাজার টা ছবি আর ভিডিও আপলোড ডাউনলোড  করে|  সেটা বাজে খরচ না? "

"ফোন এর নেশা? "

" নয় তো কি? কতলোক ফোন  করতে করতে ড্রাইভ করে এক্সিডেন্ট করে| কত লোক ফোন ব্রাউস করতে করতে রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে গাড়ি চাপা পরে| আমি তো বলবো ফোন এর নেশা সর্বনাশা| "

" খুব সমস্যা দেখছি বিয়ে করা| "

"  বলছি কি তাহলে| আর শুধু তাই নয়, যখন অফিস কাজ এর প্রেসার তুঙ্গে ওঠে, গিন্নির ঝগড়ার করার মুড তখন তুঙ্গে উঠে যায়| বুঝতে পারি না কোনদিক টা সামাল দেব আগে | একটু নেশা টেসা করলে এইসব কিছু ভুলে থাকা যায় আর কি| মনটা হালকা হয়ে যায়  "

 
 
হঠাৎ বিলটু দা আবার গা ঝাড়া দিয়ে বসলেন " বুঝলাম তোমার অবস্থা| একটা উপায় আছে কিনতু, এইসব সমস্যা থেকে মুক্তি"
প্রদীপ বাবু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন " কি বলছো , গিন্নির ঝগড়া থেকে মুক্তি, কাজ এর চাপ থেকে মুক্তি? "

" বলছি তো সেটাই| তুমি খুব ভীতু মানুষ| কাজ এর ভয়, গিন্নির ভয়| এই সমস্ত ভয় কাটিয়ে ফেললেই দেখবে জীবন পুরো শান্তি| "

" শুনতে তো ভালোই লাগছে| কিনতু কিভাবে সব ভয় দূর হবে? কি এমন ড্রাগ দেবেন? কত পয়সা লাগবে? "

"কোনো পয়সা লাগবে না, ড্রাগ ওষুধ মাদুলি কিছু লাগবে না| খালি দেখবে জীবন ভয় নেই| গিন্নি ভয় থাকবে না "



হঠাৎ করে গাছতলার পেছনের অন্ধকার থেকে নারীকণ্ঠে  গর্জন ভেসে এলো  "এই যে, অনেক্ষন ধরে তোমার বাজে বকবকানি শুনতে পাচ্ছি| কি সব গিন্নি আর সংসার নিয়ে বাজে বকে যাচ্ছ এই লোকটার সঙ্গে | "
 
বিলটু দা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন " আরে না না , আমি তো এই এদের বলছিলাম যে গিন্নিদের ভয় পেতে নেই কথাতেই বলে ওয়াইফ আর লাইফ দুটো শব্দ কিরকম rhyming "

"চুপ করো| বাজে বোকো না| ছেলেটা দুদিন ধরে ইলিশ মাছ খেতে চাইছে| ওই খাল পারে জেলে দের বাড়ি থেকে হাতিয়ে আনতে বলেছিলাম, আজকেও ভুলে গেছো?"

"  না না, মনে আছে|  ওই আরেকটু অন্ধকার হলেই যাবো ভাবছিলাম "

"  বাজে বোকো না| ঠিক জানি আবার ভুলে গেছো| আর ওই  শ্মশান এর উত্তর দিকের ক্লাব এর ছেলেদের ভয় দেখানোর কি হোলো?
" ওটাও মনে আছে| আরেকটু সন্ধ্যে ঘনাক তারপরে যাবো ভাবছিলাম | এই বিকেল কি ভয় দেখানোটা জমে?"

" চুপ করো| ওই যে শেওড়া গাছের শাকচুন্নি টা বলেছিল শুঁটকি মাছ এনেদিতে , সেটা ভুলে গেছো নিশ্চই ? "

বিলটু দা  অনেকক্ষণ পর একটা অনাবিল হাসি দিলেন " না না, মনে আছে | নিয়ে এসেছি "

গিন্নির আরো জোরালো ধমক ভেসে এলো " সেতো মনে থাকবেই| কোনো দরকার নেই এইসব আদিখ্যেতা করার| ওকে বলবে যদি নিজের খাবার না জোটে আমাদের বাড়িতে এসে  খেয়ে যেতে |"

 
 
বিলটু দা বিষন্ন হয়ে অন্ধকার এর দিকে হাঁটা দিলেন
প্রদীপ বাবু একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, মুক্তি উপায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে | পচা কে জিজ্ঞেস করলেন ": আরে আমার প্রব্লেম টা কি হবে, যে মুক্তি উপায় দেবে বললো সে তো নিজেই বৌ এর ভয় কাঁপছে  |"

পচা আঁতকে উঠলো " আরে কি সাংঘাতিক, বৌদির সামনে এইসব বোলো না, খুব বিপদ হয়ে যাবে | তুমি বোস একটু,  ছিলিম টান ফান দাও  | বিলটু দা আসছেন”

লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়া নারী মূর্তি এবার সোজাসুজি প্রদীপ বাবু সামনে প্রকট হলেন|  " এনার আবার মুক্তি চাই| অনেক ধরে তোমার প্রেসার এর গল্প শুনছি|  কি এমন কাজ তোমার যে এতো প্রেসার?"

"আমি রিয়েল এস্টেট আছি| আমার কাজ ফাঁকা জমি, পুরোনো বা ভাঙা বাড়ি জমি এইসব এর খোঁজ করা| প্রোমোটার রা জমি পিছু আমাদের কমিশন দেয়|"

"তুমি তো খুব শয়তান লোক| নিজে হাতে এইসব ফাঁকা নিরিবিলি জায়গা গুলো নষ্ট করছো| আর তারপরে এসে দুঃখ করছিলে যে গাছতলা টা ফাঁকা নেই নেশা করার জন্য? তোমার ঘাড় মটকে দেয়া উচিত| এই কে আছিস এদিকে আয় তো "

ঘাড় মটকে দেয়ার কথা শুনে প্রদীপ বাবু বেশ বিরক্তই হলেন| জায়গাটা শ্মশান বলে কি যেকোনো লাল পাড় সাদা শাড়ী পড়া মহিলা পেত্নী সুলভ ডায়ালগ দেবে? নেশা হালকা ফুরফুরে আমেজ টাও কিরকম চলে গিয়ে একটা গা ছমছম ভাব উঁকি দিচ্ছে মনের ভেতর | বিরক্ত হয়ে বললেন যে "ঘাড় মটকাবে মানে? আপনারা কি ভূত নাকি? "

পচা খুব অবাক মুখ করে বললো "কি কান্ড, শুনলেন না বৌদি বিলটুদা কে বললেন যে  ক্লাব এর ছেলেদের ভয় দেখাতে, সেটা ভূত না হলে কেন বলবে? আর শেওড়া গাছের শাকচুন্নি কে শুঁটকি মাছ কি জ্যান্ত লোক এনে দেয়? "

" আরে বাবা আমি তো ভাবলাম ওটা কথার কথা| কোনো তরুণী মহিলার সঙ্গে আমায় কথা বলতে দেখলে আমার গিন্নি তাদের পোড়ামুখী  বা শাকচুন্নি বলে ত্থাকেন |"

ভৌতিক বৌদির হঠাৎ টনক নড়লো | পচা কে হাঁক দিলেন " এই পচা, গিয়ে দেখ তো তোদের  বিলটুদা কোথায় গেলো? যা ভুলো মন, ইলিশ মাছটা আবার ওই শাকচুন্নিকে না দিয়ে আসে |"

পচা ছায়ামূর্তি মতো হঠাৎ অদৃশ্যও হয়ে গেলো|বিভিন্ন ভূতের সিনেমায়  প্রদীপ বাবু যেরকম দেখেছিলেন , হুবুহু সেইরকম| গা ছমছম ভাবটা অনেক টা ভয় ভয় ভাব বলেই মনে হওয়া শুরু হচ্ছে যেন | শেষ বারের মতো নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য ভৌতিক বৌদিকে জিগেশ করেই ফেললেন
"কিছু মনে করবেন না , আপনারা কি সত্যি ভূত নাকি?"

"আপনারা কি ভূত নাকি মানে ?  এই শ্মশানে ভূত থাকবে না তো কি তোমরা যে সব পুরোনো বাড়ি ঘর ভেঙে ফ্লাট আর মল বানাচ্ছ সেখানে ভূত থাকবে? আয় তো সবাই মিলে বেটাকে মজা টের পাইয়ে দে  "
প্রদীপ বাবু দেখলেন যে অন্ধকার এর মধ্যে থেকে প্রচুর ছায়া মূর্তি বেরিয়ে এলো| সবাই খুব বিশ্রী রকম নাকি সুরে হাসি জুড়ে দিলো | প্রদীপ বাবু প্রানপনে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলেন | কিনতু গাঁজার প্রভাবে হোক, কিংবা ভৌতিক প্রকোপেই হোক,  উনি দেখলেন আকাশ মাটি গাছ পালা সব বনবন  করে ঘুরছে, আর যেদিকে যতই দৌড়ান না কেন, সেই ছায়ামূর্তি গুলো সবসময়েই চারপাশে হেসে চলেছে | দৌড়ে লাভ হচ্ছে না দেখে বাধ্য হয়েই প্রদীপ বাবু মাটিতে বসে পড়লেন | সামনের অন্ধকার ফুঁড়ে হঠাৎ বিলটু দা প্রকট হলেন, হাতে একজোড়া ইলিশ মাছ নিয়ে | একগাল অমায়িক হেসে জিগেশ করলেন "কি ভায়া , কি বুঝলে ব্যাপার ?"

" ব্যাপার তো ভয়ানক দেখছি | আপনি আমায় মুক্তি পথ দেখাবেন বললেন নাকি মৃত্যুর পথ?"
" মৃত্যু পথেই তো আসল মুক্তি হে ভায়া | জীবন না থাকলে চাকরি , কাজ এর চাপ , গিন্নি ভয়| সব  কিছু থেকে মুক্তি | এমন কি ভূত এর ভয় থেকে মুক্তি "

" না না, এইরকম এর মুক্তি আমার চাই না| আমায় ছেড়ে দিন| রাম রাম রাম রাম| আমার বাড়িতে বৌ বাচ্ছা আছে| ছেড়ে দিন| রাম রাম রাম রাম|"
" এই দেখো, স্কচ  ছেড়ে এখন রাম" ?
" আরে rum বলিনি, ভগবান শ্রী রাম এর কথা বলেছি | রামনাম জপ করলে ভূত এর ভয় থাকে না| রাম রাম রাম রাম| "

" এতদিন তো বিপদ পড়লে বোতল এর দেবতার আরাধনা করতে | আজকে যে দেখি মন্দির এর দেবতা কে মনে পড়েছে ? এতদিন করতে পারোনি?"
"  খুব ভুল হয়ে গেছে| আর করবো না |  ভূত চতুর্দশী রাত ভূত এর কাছে কিছু চাইলে refuse  করতে নেই| আর আপনি নিজে মুক্তি দেবেন বলেছিলেন|আপনারা মতো repectable  ভূত নিশ্চই কথার খেলাপ করবেন না||  ব্যাস জীবন থেকে মুক্তি চাই না| এইটুকু দেখুন "

" ঠিক আছে| তুমি যদি আমাদের সব কথা শোনো তাহলে তোমার প্রাণ নেবো না| "
"সব শুনবো দাদা, সব শুনবো "

" তাহলে শোনো, যদি লাইফ পার্টনার এর সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারো, স্ট্রেস বা টেনশন হলে নেশা করা বন্ধ করতে পারো, মাঠ ঘাট পুকুর বাড়ি তোলা বন্ধ করতে পারো, অন্যদের ক্ষতি করা বন্ধ করতে পারো, তাহলে কোনো ভয় নেই জীবন |"
"সত্যি বলছেন? "
"অবশ্যই|  যেদিন সমস্ত মানুষ এইরকম করতে পারবে, সেদিন পুরো মানুষ জাতি ভয় শুন্য হবে| বুঝলে তো?"

প্রদীপ বাবু দেখলেন চোখের সামনে পুরো পৃথিবী বনবন করে ঘুরে চলেছে, প্রচুর হাসির আওয়াজ কানে আসছে, সামনের মূর্তি আর ছায়ামূর্তি সব মিলেমিশে একাকার, কখনো আছে, কখনো নেই | আর কিছু মাথায় ঢুকছেনা, মাথা বনবন করে ঘুরে চলেছে,  প্রদীপ বাবু জ্ঞান হারালেন |

 

পরের দিন সকালে প্রদীপ চৌধুরী কে শ্মশান পড়ে থাকতে দেখা যায় | লোকজন ওনাকে তুলে নিয়ে যায় হাসপাতালে | প্রাথমিক চিকিৎস্য, প্রেশার আর ঘুমের ওষুধ সেবন করে কিছুদিন এর মধ্যেই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন | ওনার কি হয়েছিল সেটা নিয়ে অনেক মতবিভেদ রয়েছে | যারা ভূত  বিশ্বাস করেন, তারা প্রদীপ বাবুর ভৌতিক অভিযানের কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেছেন | যারা বিজ্ঞানমনস্ক, তারা বলেছেন যে খালি পেটে বিয়ার আর গাঁজা খেয়ে ওনার মাথা ঘুরে গিয়েছিলো, আর বাকিটা ওনার হালুসিনেশন| কেউ কেউ আবার বলেন যে সত্যি কোনো গাঁজাখোর এর পাল্লায় পড়েছিলেন উনি | তারপরে বাকিটা ওনার নেশাছন্ন মস্তিষ্কের স্বপ্ন যেটাকে উনি সত্যি ভাবছেন | প্রদীপ বাবু নিজে অবশ্য এই নিয়ে খুব একটা বিচলিত না | ভূত চতুর্দশীর রাত ওনার জীবন এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে |  আজকাল বিপদ বা অশান্তি হলে উনি নেশা করে হালকা হওয়ার চেষ্টা করেন না, হয় মন্দির গিয়ে পুজো দেন, নয়তো নিজেই ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হন| গিন্নির সঙ্গে মানিয়ে চলতেও আজকাল অসুবিধে হচ্ছে না খুব একটা, বিশেষ করে সমস্ত রকম "জমিদারি ঐতিহ্য " আজকাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় | রিয়েল এস্টেট এর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন উনি, আজকাল হেরিটেজ বিল্ডিং সংরক্ষা করার একটি NGO তে কাজ করছেন | চাকরি নিয়েও তাই খুব একটা টেনশন নেই ওনার | শুধু ভূতের গল্প বা ভূতের সিনেমা থেকে উনি যতটা সম্ভব দূরে থাকেন আজকাল |

বিদেশে বাণী বন্দনা

  প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় ...