নিজের ঢাক নিজেই না পেটালে আজকের যুগে সাফল্য আসে না । ম্যানেজমেন্ট এর লাইন এ কাজ করি, তাই এই কথাটা প্রতিনিয়ত মেনে চলতে হয় । আমি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই এই পন্থায় বিশ্বাসী। এছাড়া নিজের কাজ গুলোকে একটু বাড়িয়ে রং মাখিয়ে প্রকাশ করলে যে ঢাক পেটানোটা আরো জোরদার হয়, এটাও আমি ছোট বেলা থেকেই দেখেছি।
ক্লাস নাইন এ পড়ি যখন, একদিন একটা আন্ডার ফিফটিন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ম্যাচ খেলে ম্যান অফ দা ম্যাচ হয়ে বাড়ি এলাম। মা জানতে চাইলো যে ম্যাচ এ কে কেমন খেলেছে। আমি বললাম আমাদের টীম এর প্রসূন এমন বল করেছে, যে প্রতিপক্ষ অল্প রানেই আউট হয়ে গেছে। মা অবাক হয়ে গেলো "তাহলে প্রসূন কেন ম্যান অফ দা ম্যাচ হলো না?"
আমি বললাম, " ব্যাটিং করার সময়ে এমন ভাবে ব্যাট করছিলাম যে এখানে ব্যাট করা যেন খুব মুশকিল , ইচ্ছে করে ম্যাচটা শেষ দশ বল অবধি নিয়ে গেলাম "
মা খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলো " এরকম কেন করলি? ইচ্ছে করে বাজে খেলা কে matchfixing না spotfixing কি একটা বলা হয় না আজকাল?"
আমি বুঝিয়ে বললাম "মা, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। জানোতো , লোকজন সেটাকেই মূল্য দেয় যেটা অনেক কষ্ট করে অর্জন করা জিনিস মনে করে। আমি এমন ভাব দেখলাম যে এখানে উইকেট পাওয়া বা বল করা খুব সহজ, ব্যাট করাটাই মুশকিল। সেইজন্যই তো প্রসূন এর জায়গায় আমাকে ম্যান অফ দা ম্যাচ করলো "
এরপরে অনেক দিন কেটে গেলো, আমিও স্কুল এর গন্ডি পেরিয়ে কলেজ এ ভর্তি হলাম। হোস্টেল এর বেপরওয়া জীবন, ছেঁড়াখোঁড়া জিন্স আর একমাসের না কামানো দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। এইসবের জন্য মা এমন গালাগালি করে যে হোস্টেল থেকে বাড়ি যাওয়া কমে মাসে একবার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও যখনই বাড়ি যাই মা প্রশ্ন করে "এরকম উশখোখুষ্কো চেহারা বানিয়ে রাখিস কেন?"
আমায় বাধ্য হয়ে বোঝাতে হয় যে "উফফ বোঝো না মা, কলেজের সবচেয়ে পপুলার ছেলে আমি। বন্ধুরা সবাই আমায় মাথায় করে রাখে, জুনিয়র ছেলেরা সব ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসে , জুনিয়র মেয়েরা রেগুলারলি আমার কাছে পড়া বুঝতে চায় "
মা আরো অবাক হয়ে গেলো "তোর মতো ফাঁকিবাজ ছেলের কাছে পড়া বুঝতে চায় কেন? তোদের কলেজের যে ফার্স্ট বয়, বদ্রীনাথ, ওর কাছে বুঝলেই তো পারে"
আমি আবার বুঝিয়ে বললাম " আমাদের যে ফার্স্ট বয়, বদ্রী, ওর ফার্স্ট হওয়াটা তো সবাই খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়। ওর মা স্কুল এর প্রিন্সিপাল, বাবা আর দাদা কলেজ এর প্রফেসর, এমনকি ওদের ড্রাইভারও মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সবাই জানে যে ওদের পরিবার মা সরস্বতী আর মা লক্ষ্মী , দুজনেরই আশীর্বাদ ধন্য। আর এদিকে আমায় দেখো, ছেঁড়া জিন্স, ভাঙা সাইকেল আর বন্ধুদের জামা জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াই ।"
মা তাও প্রশ্ন করেই যায় "তাতে কি এসে যায়?"
বাধ্য হয়েই আরো খোলসা করে বলতে হয় "উফফ তুমি এটাও বোঝো না। মানুষ সেটাকেই বেশি মূল্য দেয় যেটাকে কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। আমার ছেঁড়া জিন্স, ভাঙা সাইকেল আর বন্ধুদের জামা জ্যাকেট দেখে সবাই ভাবে কতনা কষ্ট করে কলেজ করছি। তাই তো আমি যাই করি সবাই সেটারই দারুন প্রশংসা করে। এইভাবেই এতো popular হয়েছি। "
ক্রমশ কলেজ শেষ করে চাকরি জীবন শুরু করলাম। বলাই বাহুল্য, সেখানেও নিজের ঢাক পেটানো বজায় রেখে গেলাম। অফিস এ রোজ চার থেকে পাঁচ বার চা কফি খাবার জন্য অফিসের নিচে গিয়ে আড্ডা দেই। এছাড়া অফিসের কম্পিউটার থেকে (সদ্য শেখা) ইন্টারনেট মারফত সমস্ত বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখি। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই এরকম একটা হাবভাব দেখাই বড়কর্তাদের সামনে যে আমি যেন প্রচন্ড ব্যস্ত । সারাদিন কাজ না করে ফাঁকি মারার জন্য কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে রোজই মাঝরাত হয়ে যায়। তা সত্বেও অফিস মহলে আমার খুবই সুনাম এবং বড়কর্তারা আমাকে খুবই স্নেহ করেন।
এখনো মা এই জগতের ধরণ ধারণ বুঝতে পারেনি। মাঝে মধ্যেই জিগেশ করে "তোর মতো ফাঁকিবাজ কে এতো প্রশংসা করে কেন সবাই?"
আমায় আবার আমার পুরোনো ফর্মুলা বোঝাতে হয় " এখনো বুঝলে না? যারা সারাদিন মন দিয়ে কাজ করে সন্ধ্যে ছটায় বেরিয়ে যায়, সবাই ভাবে তারা ফাঁকিবাজ, তাড়াতাড়ি বাড়ি পালাচ্ছে। সারাদিন কি করি কেউ খবর রাখে না, কিন্তু সারারাত জেগে কষ্ট করে কাজ করা দেখলেই সবাই ভাবে খুব পরিশ্রমী, খুব দায়িত্বশীল। বুঝলে না ব্যাপারটা? সহজ এ হওয়া কাজকে কেউ মূল্য দেয় না, কষ্ট করে অর্জন করা সাফল্যকেই সবাই মূল্য দেয়। "
এইভাবেই দিন চলতে থাকলো। কর্মব্যস্ত জীবন ক্রমশই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। ইদানিং অফিসেও বহু রকম এর লোকজন এসেছে, নানান মতবাদ এবং নানান মনোমালিন্য। এইসবের মধ্যে সবাইকে ম্যানেজ করে এবং সবার মন জয় করে টিকে থাকতে হয়। ম্যানেজমেন্ট এর চাকরির এই এক সমস্যা, সব দিক ম্যানেজ করতে গিয়ে নিজের আর টাইম ম্যানেজ করা হয় না। কলকাতায় যাওয়া তো অনেক দূরের কথা, কলকাতায় ফোন করাও আজকাল কমে গেছে।
এরকম এক কর্মব্যস্ত দিনে কাজের ফাঁকে অফিস থেকে মাকে ফোন করেছি। সাধারণ কুশলবার্তার পর্ব সেরে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলাম "আর ভালো লাগে না, বুঝলে।এতো কাজের চাপ "
যথারীতি মা চিন্তিত হয়ে পড়লো "সত্যি তো, এতো টেনশন নিয়ে কাজ করতে হলে তো শরীর খারাপ হবে, তুই বরং ছুটি নিয়ে কলকাতা চলে আয়। কয়েকদিন মাছেরঝোল ভাত খেয়ে দুবেলা ভাত ঘুম দিয়ে চাঙ্গা হয়ে যাবি।"
কিন্তু খুব একটা উৎসাহিত হতে পারলাম না " আমার ম্যানেজার ছুটি তে যাবে পরের মাসে, ঐসময় আমাকে ওনার সব কাজ সামলাতে হবে। একদিনও ছুটি পাবো না "
মা আবার নতুন উৎসাহ নিয়ে শুরু করলো "তাহলে তার পরের মাসে চলে আয়। তোর জন্মদিন ও আছে ওই সময় , বহুবছর হয়ে গেলো জন্মদিনে বাড়ি থাকিস না"
এবারেও উৎসাহিত হতে পারলাম না " আমার জন্মদিনের সময় এখানেই থাকতে হবে, অফিসের একদল কলিগ ঠিক করেছে আমার জন্য কেক আনবে ঐদিন, আরেকদল কলিগ বলেছে যে তার আগেরদিন আমার জন্মদিন উপলক্ষে ডিনার পার্টি রাখবে। আবার প্রতিবেশী বন্ধুরা কেক নিয়ে বাড়িতে আসে, ওদেরকে একদিন ডেকে খাওয়াতেও হবে তো। "
মা বেশ অবাক হয়েই বললো "একটা জন্মদিনের তিনবার অনুষ্ঠান, বিশাল ব্যাপার তো !"
আমি একটু হালকা গর্ব নিয়েই বললাম "অনুষ্ঠানগুলো বিশাল ব্যাপার নয়, ওগুলো তো নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু হ্যাঁ, এই আত্মীয়স্বজন বিহীন বিদেশে বসেও যে এতগুলো লোকের এটেনশন পাচ্ছি, এটা কিন্তু বেশ বিশাল ব্যাপার, তাই না?"
মা স্বীকার করলো "হ্যাঁ , সত্যি এটা বিশাল ব্যাপার।"
আমি উৎসাহিত হয়ে চালু করলাম "আসলে ম্যানেজমেন্ট লাইন এ কাজ করি তো, এই চাকরিতে টিকে থাকার জন্য লোকজনের সঙ্গে কানেক্শন রাখাটাই আসল । শুধু যে এখানে পঞ্চাশটা লোক আমাকে এটেনশন দিচ্ছে, তাই নয়, ফেসবুক আর লিঙ্কডিন মিলিয়ে আমার দেড়হাজার এর বেশি বন্ধু। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক লোকজনকে চা কফি খাইয়ে, অনেক লোকজনের সঙ্গে মিটিং মিছিল করে এইজায়গায় এসে পৌঁছেছি আজকে। এটা কি চাট্টিখানি কথা ?"
আমার অবুঝ মা এতদিনে দেখলাম বুঝতে শিখেছে "চাট্টিখানি কথা কেন হবে? এমনিতেই , কষ্ট করে অর্জন করা যেকোনো জিনিস আমরা মূল্যবান ভাবি , আর তুই এতো কষ্ট করে এতগুলো মানুষের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা পাচ্ছিস, এটা তো বিশাল ব্যাপার । চাট্টিখানি কথা যদি কিছু হয়, সেটা হলো সহজে পাওয়া জিনিস । অনেকটা ধর সন্তানের প্রতি মাবাবার ভালোবাসার মতো, তাই না? যেটা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই সবসময় পাওয়া যায় । তাইতো বাবামার এই সহজে পাওয়া ভালোবাসাকে মূল্য না দিয়ে কষ্ট করে অর্জন করা শুভেচ্ছা ভালোবাসা গুলোকেই আজকাল বেশি মূল্য দেওয়া হয়।"