Monday, June 29, 2020

ফান্ড raising এর ফান্ডা


 [আমেরিকার কোনো এক বাঙালীবহুল রাজ্যের কথা , যেখানে মানুষজন মাসে আট দশটা পার্টি করেই থাকে । কোনো এক বিপজ্জনক ভাইরাস এসে বসন্ত কালটা মাটি করে দিয়েছে , কিন্তু সবাই আশা করে রয়েছে খুব শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এবং সমস্ত বাঙালি আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে । এরাজ্যের দুটি নামি জনপ্রিয় অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালি ক্লাব চালান দীপা এবং মিতা ]

 মিতা : দীপা শোন, খুব দরকারি কথা বলছি

দীপা: হ্যা মিতা দি বোলো

মিতা : দেখ, এখানে ইভেন্ট বা প্রোগ্রামগুলোর কি হবে ভেবেছিস?

দীপা: কেন, আউটডোর গ্যাদারিং তো হচ্ছেই আজকাল, বাকি সব নিশ্চই ঠিক হয়ে যাবে

মিতা : দেখ, এখন সবাই বলবে ছোট ছোট GROUP গ্যাদারিং করতে। তখন এই নিউ জার্সির ছোট ছোট বাঙালি GROUP গুলো কিন্তু হেভি পপুলার হবে

দীপা: হা, ডিসগাস্টিং, এতো এতো বাঙালি GROUP আর ক্লাব কোথা থেকে যে আসে ??

মিতা : জানিস না আবার, 10 টা বাঙালি হলেই বলে GROUP, কুড়িটা বাঙালি হলেই ক্লাব তারপরে সেখানে দলাদলি, আর তারপরে আরেকটা ছোট রেবেল GROUP

দীপা: হা জানি তো, আমাদের ক্লাব  থেকেই তো তোমাদের ক্লাব টা break আউট করেছিল না বছর কুড়ি আগে?

মিতা : এই, যা জানিস না তাই নিয়ে বক বক করিস কেন বলতো? কুড়ি বছর আগে তুই এখানে ছিলিস? তোদের ক্লাব এর পুরোনো হর্তাকর্তা সবাই আমার বাড়িতে কতগুলো potluck করেছে জানিস?

দীপা: আচ্ছা বাদ দাও পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে কাজ নেই তুমি কি বলবে বলছিলে?

মিতা : বলছি এই ক্রাইসিস এর সময়ে আমরা সব বিভেদ ভুলে একটা জয়েন্ট কিছু ইভেন্ট করি, এই ছোট ক্লাব গুলো মাথাচাড়া দেয়ার আমরা সবাইকে স্টিম রোল করে দেব

দীপা: আইডিয়া টা দারুন, কিন্তু কি করবো ? পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ সব তো হয়ে গেলো , পুজো আসতে অনেক দেরি,

মিতা : ফান্ড রেসিং করবো রে কিছু টাকা আসবে, আর সোশ্যাল মিডিয়া তে দারুন পাবলিসিটি হবে

দীপা: হা, তার ওপরে তোমাদের ক্লাব এর তো প্রচুর স্পনসর আর প্রচুর ফলোয়ার। ওদের পুরোদমে কাজে লাগাতে হবে কিন্তু

মিতা : তোদের ক্লাব এর কালচারাল প্রোগ্রাম গুলো দারুন হয়, তোদের সব কটা ভালো সিঙ্গার আর ডান্সার লাগবে কিন্তু,  এখন তো দেশ থেকে আর্টিস্ট আনা যাবে না,

দীপা: ওকে। সানডে সকালে কথা বলছি

***********************************************

দীপা: এই সীমা শোন, আমরা যে গার্লস জুম্ মিটিং এ পরের মাসের ফান্ড raiser টা নিয়ে কথা বলছিলাম, ওটায় কিন্তু তোকেই anchoring করতে হবে। আর ওপেনিং ইন্ট্রোডাকশন

সীমা: আমি? কেন তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড করবে না?

দীপা: বেস্ট ফ্রেন্ড না ছাই! তুই আমার কলেজের জুনিয়র, আমার ছোট বোনের মতো, তাই তোকেই বলছি।  আমি লাস্ট 3 মাসে এতো গুলো রান্নার ছবি পোস্ট করলাম, এতো গুলো শাড়ী চ্যালেঞ্জ পোস্ট করলাম, একটাও লাইক দিয়েছে?

সীমা: বেচারি অফিস নিয়ে এতো busy দেখার টাইম পায়নি হয়তো

দীপা: সে যাই হোক, শোন তুই খুব ভালো কানেক্ট করতে পারিস অডিয়েন্স এর সঙ্গে, প্লাস তুই এতো famous হয়েছিস শর্ট ফিল্ম করে

সীমা; আচ্ছা আমাদের এই ফান্ড রেসিং টা কিসের জন্য হবে?

দীপা; ভালো কথা, ওটা তো জিগেস করাই হয়নি দাঁড়া

***********************************************

মিতা : হ্যা রে বল

দীপা: মিতা দি, বলছিলাম কি এই ফান্ড রেসিং টা কিসের জন্য হবে?

মিতা : কেন? ভিক্টিম দের সাহায্য করার

দীপা: করোনা না এমফান এর ?

মিতা : যা হোক একটা কিছু করলেই হয়

দীপা: অলরেডি কিন্তু কয়েকটা  ফান্ড রেসিং হয়ে গেছে এই সব নিয়ে

মিতা : তাহলে নেপোটিজম ভিক্টিম দের জন্য?

দীপা: নেপোটিজম ভিক্টিম দের জন্য ফান্ড রেসিং ?

মিতা : হা, বলিউড এর যা গ্ল্যামার, আর বাঙালি রা আজকাল গ্ল্যামার জগতের এর ফ্যান , ফান্ড রেসিং এর টাকা দিয়ে গরিব লোকদের বাড়ি বানাবো বললে কেউ টাকা দিক বা না দিক, ফান্ড রেসিং এর টাকা দিয়ে বলিউড নেপোটিজম ভিক্টিম দের হেল্প করবো বললে সবাই দেবে 

দীপা: কিন্তু এটা করে কি লাভ হবে?

মিতা : বলিউড এর নেপোটিজম ভিক্টিম অভিনেতা অভিনেত্রী রা ফেইসবুক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করবে, এটা বললেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে

দীপা: বলছো?

মিতা : দরকার হলে এটাও বলবো যে ইরফান খান এর পরিবার কে টাকা পাঠানো হবে

দীপা: ইরফান খান তো ক্যান্সার মারা গেলেন নেপোটিজম এর সঙ্গে কি সম্পর্ক

মিতা : ধুর লোকজন অত মনে রাখে না।  ভালো অভিনেতা ছিলেন, অসাধারণ কিছু সিনেমা করেছেন, ফ্যামিলি ব্যাকআপ নিয়ে বলিউড আসেন নি , মারা গেলেন - এই সব কটা যোগ করলে তো নেপোটিজম দাঁড়ায় নাকি ?

দীপা: আচ্ছা দাড়াও তোমার সঙ্গে রবিবার ডিটেল কথা বলছি

***********************************************

 

দীপা: ফান্ড রেসিং এর agenda টা আমরা ওয়ার্ক আউট করছি । তুই তোর মতো স্ক্রিপ্ট লিখতে থাক

সীমা: আচ্ছা দীপা দি, এই ফান্ড রেসিং এর টাকাটা কিভাবে দুটো ক্লাব শেয়ার হবে

দীপা: টাকা উঠলে তো শেয়ার হবে।  সবাই আসবে, ফ্রি তে ইভেন্ট দেখবে, দেখে বাহবা দিয়ে চলে যাবে, আমাদের ঝক্কি কম। 

সীমা: তাহলে পুরো arrangement ফ্লপ?

দীপা: ফ্লপ কেন? সোশ্যাল মিডিয়া তে সবাই দেখবে এতো ভালো ইভেন্ট হলো, নেক্সট পুজো যখন হবে সবাই আমাদের প্রোগ্রাম দেখতেই আসবে

সীমা: কিন্তু কোরোনার জন্য যারা রোজগার হারালো, এমফান যাদের বাড়ি ঘর ভেসে গেলো, তাদের জন্য আমরা কি কিছু করবো না ? যখন তুমি কলেজ আমাদের লিডার ছিলেতুমি তো বলতে corrupt social system এর বিরুদ্ধে বিপ্লব আনার কথা ,তুমি তো বলতে সাধারণ লোকের পাশে দাঁড়াতে হবে । কি একটা বলতে যেন তুমি - বিত্তহীনদের অর্থহীন করে রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব আনার কথা

দীপা: উফফ এখন কি আর ওই ছাত্র রাজনীতি করার মতো বয়েস আছে? বিপ্লব আমি এখনও করি কিন্তু সেটা with sophistication। সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমি আজও গর্জে উঠি - সোশ্যাল পার্টি থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সব জায়গাতে

সীমা: তুমি কিরকম চেঞ্জ হয়ে গেছো, জানো।  সোসালিষ্ট লিডার থেকে  কি করে এরকম সোশ্যাল লিস্ট এর লিডার হয়ে গেলে? 

দীপা: চেঞ্জ আমি একা হয়েছি? তোদের শিবু দা হয়নি? দুবছর ধরে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন চালালো কমিউনিস্ট চিন্তাধারায়, আর আজকে ক্যাপিটালিস্ট হয়ে বসে আছে?

সীমা: কি বলছো তুমি? শিবু দা ক্যাপিটালিস্ট?

দীপা: ক্যাপিটাল জমা করচে রে, আজকাল কলেজ এর যা খরচ, এখন থেকে প্রানপনে পয়সা জমাচ্ছ বাচাদের জন্য যে আগে প্রতি শুক্রবার আমাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যেত, সে আমায় লাস্ট বছরে একটাও সিনেমা নিয়ে যায় নি এখন বলে যে অনলাইন আসা অবধি অপেক্ষা করতে, বাজে খরচ করা যাবে না এখন

সীমা: আর মনে করো, একদিন তুমি ডাক তুলেছিলে "নিপীড়িতদের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিতে হবে" 

দীপা: দেখ, রোমান্টিক ফুলিসনেস এর দিন গেছে। ব্যাগ  দুশো বা পাঁচশো টাকা সম্বল হলে  নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার কথা বলা খুব সহজ, কিন্তু দুশো বা পাঁচশো যখন দুহাজার বা পাঁচ হাজার হয়ে যায়, টাকাটা যখন ডলার হয়ে যায়, মাথার ওপরে বাবা মা ছাতা থাকে না, নিজের সংসারের দায়িত্ত্ব এসে যায়, তখন না এইসব বিলিয়ে দেয়ার কথা বার্তা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়

সীমা: কয়েকদিন আগে যে ফেইসবুক দেখলাম তুমি ভারত সেবাশ্রম   পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছো

দীপা: সত্যি কথা বলতে কি, আমার ডোনেশান- আমার স্ট্যাটাস মেইনটেইন করার একটা চেষ্টা।  লোকে দেখবে যে আমি কত ভাবছি সমাজের জন্য, তাই বাধ্য হয়ে বাকিরাও স্টেটাস দেখানোর জন্য NGO তে টাকা দেবে এইভাবেই আবার বিপ্লব আসবে

সীমা: সত্যি বলতো , তোমার এই জীবন টা ভালো লাগে?

দীপা: নিশ্চই খারাপ কি বলতো জীবন টা?

সীমা: আগে তোমার পাশে দাঁড়ানোর মতো অনেক বন্ধু ছিল…….

দীপা: এখনো আছে, একবার খালি বলতে হয় 'আয়রে সেলফি তুলবো ' - কত্ত বন্ধুরা সারি দিয়ে এসে দাঁড়ায় আমার পাশে 

সীমা: আমি সত্যিকারের বন্ধু বলছিলাম…..

দীপা: ধুর পাগলী, যেটা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যায় সেটাই তো সত্যি রে

সীমা: তুমি যে বলেছিলে এমন একটা জীবন দেখতে চাও যেখানে যে কোনো class divide থাকবে না।  কি একটা বলতে তুমি "দরিদ্র আর ধনীর শ্রেণীভেদ আর থাকবে না"

দীপা: নেই তো। আজকাল এখানে সবাই শুধু বিত্ত্ববানদের শ্রেণীভেদ করে। কার একটা গাড়ি আর কার দুটো গাড়ি, কার দুটো বেডরুম কার তিনটে বেডরুম আর কার চারটে বেডরুম

সীমা: তুমি যে স্বপ্ন দেখতে অশিক্ষা দূর করার

দীপা: ওটা তো ছোটবেলার immaturity এতো বোকা ছিলাম, ভাবতাম শিক্ষা মানে মনের বিকাশ, শিক্ষা মানে সামাজিক শিকল ভাঙার প্রয়াস

সীমা: তো সেখানে ভুল কোথায়?

দীপা: ভুল, সব ভুল এখন শিখে গেছি যে শিক্ষা হলো পয়সা কমানোর প্রয়াস, কিছু মেকি সামাজিক স্টেটাস এর পাথেয় , যার শেষ পরিনাম নিজেকে আরো হাজারটা সামাজিক শিকলে বেঁধে ফেলা

এদেশের so-called  শিক্ষিত বাঙালিদের দেখে ভুলটা বুঝে গেছি, অপ্রতিষ্ঠিত অশিক্ষিত  লোকগুলোই  ভালো আছে। ওদেরকে আর আমাদের মতো শিক্ষিত করে কাজ নেই

 


Sunday, May 10, 2020

অবুঝ মা

নিজের ঢাক নিজেই না পেটালে আজকের যুগে সাফল্য আসে না  ম্যানেজমেন্ট এর লাইন  কাজ করিতাই এই কথাটা প্রতিনিয়ত মেনে চলতে হয়  আমি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই এই পন্থায় বিশ্বাসী। এছাড়া নিজের কাজ গুলোকে একটু বাড়িয়ে রং মাখিয়ে প্রকাশ করলে যে ঢাক পেটানোটা আরো জোরদার হয়এটাও আমি ছোট বেলা থেকেই দেখেছি।

 ক্লাস নাইন  পড়ি যখনএকদিন একটা আন্ডার ফিফটিন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ম্যাচ খেলে ম্যান অফ দা ম্যাচ হয়ে বাড়ি এলাম। মা জানতে চাইলো  যে ম্যাচ   কে কেমন খেলেছে। আমি বললাম আমাদের টীম এর প্রসূন এমন বল করেছেযে প্রতিপক্ষ অল্প রানেই আউট হয়ে গেছে। মা অবাক হয়ে গেলো "তাহলে প্রসূন কেন ম্যান অফ দা ম্যাচ হলো না?"
আমি বললাম, " ব্যাটিং করার সময়ে এমন ভাবে ব্যাট করছিলাম যে এখানে ব্যাট করা যেন খুব মুশকিল , ইচ্ছে করে ম্যাচটা শেষ দশ বল অবধি নিয়ে গেলাম "
মা খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলো " এরকম কেন করলিইচ্ছে করে বাজে খেলা কে matchfixing  না spotfixing কি একটা বলা হয় না আজকাল?"
আমি বুঝিয়ে বললাম "মাতোমাকে নিয়ে আর পারি না। জানোতো , লোকজন সেটাকেই মূল্য দেয় যেটা অনেক কষ্ট করে অর্জন করা জিনিস মনে করে। আমি এমন ভাব দেখলাম যে এখানে উইকেট পাওয়া বা বল করা খুব সহজব্যাট করাটাই মুশকিল। সেইজন্যই তো প্রসূন এর জায়গায় আমাকে ম্যান অফ দা ম্যাচ করলো "


এরপরে অনেক দিন কেটে গেলোআমিও স্কুল এর গন্ডি পেরিয়ে কলেজ  ভর্তি হলাম। হোস্টেল এর বেপরওয়া জীবনছেঁড়াখোঁড়া জিন্স আর একমাসের না কামানো দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। এইসবের জন্য মা এমন গালাগালি করে যে হোস্টেল থেকে বাড়ি যাওয়া কমে মাসে একবার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও যখনই বাড়ি যাই মা প্রশ্ন করে "এরকম উশখোখুষ্কো চেহারা বানিয়ে রাখিস  কেন?"
আমায় বাধ্য হয়ে বোঝাতে হয় যে "উফফ বোঝো না মাকলেজের সবচেয়ে পপুলার ছেলে আমি। বন্ধুরা সবাই আমায় মাথায় করে রাখে, জুনিয়র ছেলেরা সব ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসে , জুনিয়র মেয়েরা রেগুলারলি আমার কাছে পড়া বুঝতে চায় "
মা আরো অবাক হয়ে গেলো "তোর মতো ফাঁকিবাজ ছেলের কাছে পড়া বুঝতে চায় কেনতোদের কলেজের যে ফার্স্ট বয়বদ্রীনাথ, ওর কাছে বুঝলেই তো পারে"
আমি আবার বুঝিয়ে বললাম " আমাদের যে ফার্স্ট বয়, বদ্রী,  ওর ফার্স্ট হওয়াটা তো সবাই খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়। ওর মা স্কুল এর প্রিন্সিপালবাবা আর দাদা কলেজ এর প্রফেসরএমনকি ওদের ড্রাইভারও মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সবাই জানে যে ওদের পরিবার মা সরস্বতী আর মা লক্ষ্মী , দুজনেরই আশীর্বাদ ধন্য। আর এদিকে আমায় দেখোছেঁড়া জিন্সভাঙা সাইকেল আর বন্ধুদের জামা জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াই "
মা তাও প্রশ্ন করেই যায় "তাতে কি এসে যায়?"
বাধ্য হয়েই আরো খোলসা করে বলতে হয় "উফফ তুমি এটাও বোঝো না। মানুষ সেটাকেই বেশি মূল্য দেয় যেটাকে কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। আমার ছেঁড়া জিন্সভাঙা সাইকেল আর বন্ধুদের জামা জ্যাকেট দেখে সবাই ভাবে কতনা কষ্ট করে কলেজ করছি। তাই তো আমি যাই করি সবাই সেটারই দারুন প্রশংসা করে। এইভাবেই এতো popular হয়েছি। "


ক্রমশ কলেজ শেষ করে চাকরি জীবন শুরু করলাম। বলাই বাহুল্যসেখানেও নিজের ঢাক পেটানো বজায় রেখে গেলাম। অফিস  রোজ চার থেকে পাঁচ বার চা কফি খাবার জন্য অফিসের নিচে গিয়ে আড্ডা দেই। এছাড়া অফিসের কম্পিউটার থেকে (সদ্য শেখাইন্টারনেট মারফত সমস্ত বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখি। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই এরকম একটা হাবভাব দেখাই বড়কর্তাদের সামনে যে আমি যেন প্রচন্ড ব্যস্ত  সারাদিন কাজ না করে ফাঁকি মারার জন্য কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে রোজই মাঝরাত হয়ে যায়। তা সত্বেও অফিস মহলে আমার খুবই সুনাম এবং বড়কর্তারা আমাকে খুবই স্নেহ করেন।
এখনো মা এই জগতের ধরণ ধারণ বুঝতে পারেনি। মাঝে মধ্যেই জিগেশ করে "তোর মতো ফাঁকিবাজ কে এতো প্রশংসা করে কেন সবাই?"
আমায় আবার আমার পুরোনো ফর্মুলা বোঝাতে হয় " এখনো বুঝলে নাযারা সারাদিন মন দিয়ে কাজ করে সন্ধ্যে ছটায় বেরিয়ে যায়সবাই ভাবে তারা ফাঁকিবাজতাড়াতাড়ি বাড়ি পালাচ্ছে। সারাদিন কি করি কেউ খবর রাখে না, কিন্তু সারারাত জেগে কষ্ট করে কাজ করা দেখলেই সবাই ভাবে খুব পরিশ্রমীখুব দায়িত্বশীল। বুঝলে না ব্যাপারটাসহজ  হওয়া কাজকে কেউ মূল্য দেয় নাকষ্ট করে অর্জন করা সাফল্যকেই সবাই মূল্য দেয়। "


এইভাবেই দিন চলতে থাকলো। কর্মব্যস্ত জীবন ক্রমশই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো।  ইদানিং অফিসেও বহু রকম এর লোকজন এসেছেনানান মতবাদ এবং নানান মনোমালিন্য। এইসবের মধ্যে সবাইকে ম্যানেজ করে এবং সবার মন জয় করে টিকে থাকতে হয়। ম্যানেজমেন্ট এর চাকরির এই এক সমস্যাসব দিক ম্যানেজ করতে গিয়ে নিজের আর টাইম ম্যানেজ করা হয় না। কলকাতায় যাওয়া তো অনেক দূরের কথাকলকাতায় ফোন করাও আজকাল কমে গেছে।
এরকম এক কর্মব্যস্ত দিনে কাজের ফাঁকে অফিস থেকে মাকে ফোন করেছি। সাধারণ কুশলবার্তার পর্ব সেরে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলাম "আর ভালো লাগে নাবুঝলে।এতো কাজের চাপ " 
যথারীতি মা চিন্তিত হয়ে পড়লো "সত্যি তোএতো টেনশন নিয়ে কাজ করতে হলে তো শরীর খারাপ হবেতুই বরং ছুটি নিয়ে কলকাতা  চলে আয়। কয়েকদিন মাছেরঝোল ভাত খেয়ে দুবেলা ভাত ঘুম দিয়ে চাঙ্গা হয়ে যাবি।"
কিন্তু খুব একটা উৎসাহিত হতে পারলাম না " আমার ম্যানেজার ছুটি তে যাবে পরের মাসেঐসময় আমাকে ওনার সব কাজ সামলাতে হবে। একদিনও ছুটি পাবো না "
মা আবার নতুন উৎসাহ নিয়ে শুরু করলো "তাহলে তার পরের মাসে চলে আয়। তোর জন্মদিন  আছে ওই সময় , বহুবছর হয়ে গেলো জন্মদিনে বাড়ি থাকিস না"
এবারেও উৎসাহিত হতে পারলাম না " আমার জন্মদিনের সময় এখানেই থাকতে হবেঅফিসের একদল কলিগ ঠিক করেছে আমার জন্য কেক আনবে ঐদিনআরেকদল কলিগ বলেছে যে তার আগেরদিন আমার জন্মদিন উপলক্ষে ডিনার পার্টি রাখবে। আবার প্রতিবেশী বন্ধুরা কেক নিয়ে বাড়িতে আসেওদেরকে একদিন ডেকে খাওয়াতেও হবে তো। "
মা বেশ অবাক হয়েই বললো "একটা জন্মদিনের তিনবার অনুষ্ঠানবিশাল ব্যাপার তো !"
আমি একটু হালকা গর্ব নিয়েই বললাম "অনুষ্ঠানগুলো বিশাল ব্যাপার নয়ওগুলো তো নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু হ্যাঁএই আত্মীয়স্বজন বিহীন বিদেশে বসেও যে এতগুলো লোকের এটেনশন পাচ্ছিএটা কিন্তু বেশ বিশাল ব্যাপারতাই না?"
মা স্বীকার করলো "হ্যাঁ , সত্যি এটা বিশাল ব্যাপার।"
আমি উৎসাহিত হয়ে চালু করলাম "আসলে ম্যানেজমেন্ট লাইন  কাজ করি তোএই চাকরিতে টিকে থাকার জন্য লোকজনের সঙ্গে কানেক্শন রাখাটাই আসল  শুধু যে এখানে পঞ্চাশটা লোক আমাকে এটেনশন দিচ্ছেতাই নয়ফেসবুক আর লিঙ্কডিন মিলিয়ে আমার দেড়হাজার এর বেশি বন্ধু।   অনেক কাঠখড় পুড়িয়েঅনেক  লোকজনকে চা কফি খাইয়েঅনেক লোকজনের সঙ্গে মিটিং মিছিল করে এইজায়গায় এসে পৌঁছেছি আজকে। এটা কি চাট্টিখানি কথা ?"
আমার অবুঝ মা এতদিনে দেখলাম বুঝতে শিখেছে "চাট্টিখানি কথা কেন হবেএমনিতেই , কষ্ট করে অর্জন করা যেকোনো জিনিস আমরা মূল্যবান ভাবি , আর তুই এতো কষ্ট করে এতগুলো মানুষের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা পাচ্ছিসএটা তো বিশাল ব্যাপার  চাট্টিখানি কথা যদি কিছু হয়সেটা হলো সহজে পাওয়া জিনিস  অনেকটা ধর সন্তানের প্রতি মাবাবার ভালোবাসার মতোতাই নাযেটা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই সবসময় পাওয়া যায় । তাইতো বাবামার এই সহজে পাওয়া ভালোবাসাকে মূল্য না দিয়ে কষ্ট করে অর্জন করা শুভেচ্ছা ভালোবাসা গুলোকেই আজকাল বেশি মূল্য দেওয়া হয়।"

বিদেশে বাণী বন্দনা

  প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় ...