Saturday, March 28, 2020

আমেরিকার দুর্গাপূজা

                                                                                                                                         সূর্য্য

রবি ঠাকুর লিখেছিলেন যে আমরা বাঙালিরা চঞ্চল এবং সুদূরের পিয়াসী। শুধু যে আমরা সুদূরেই যাই, তা নয়, সুদূরে যাওয়ার সময় আমরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই। তাই তো সাবর্ণ রায়চৌধুরীর দুর্গাপূজা কলকাতা ছাড়িয়ে ভারতের সমস্ত বড় শহর, এমনকি ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন শহরেও উদযাপিত হয়। আমেরিকায় আসার সময় এরকমটাই শুনেছিলাম তাই ২০০৬ সালে , আমার আমেরিকার প্রথম দুর্গাপূজার একমাস আগে থেকেই খোঁজ খবর শুরু করে দিলাম যে কাছাকাছি কোথায় পূজা হয়, এবং আমার অফিস থেকে মিনিট চল্লিশেকের দূরত্বেই একটা বাঙালি পুজোর খোঁজ পেয়ে গেলাম।

ছোটবেলায় দেখতাম যে পুজোর প্যান্ডেলে বাঁশ পড়ছে মানেই স্কুল কলেজ ছুটি আমেরিকায় কিন্তু উল্টো ব্যবস্থা, মানে স্কুল বিল্ডিং এর ভেতরেই সব পুজো হয়। যাই হোক, আমেরিকার মাটিতে, স্কুল এর ভেতরে মা দুর্গার দর্শন পেয়ে খুব ভালো লাগলো। প্রথম আবেগ এর ধাক্কা টা সামলে উঠে তারপরে চেষ্টা শুরু করলাম কার কার সঙ্গে আলাপ করা যায়। সোমক নামের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ জমে গেলো, সাউথ কলকাতার ছেলে, আমার থেকে বছর পাঁচেক এর বড় হবে । ওর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতেও পারলাম। আর ঘন্টাখানেক এর মধ্যেই দেখলাম দশ পনেরোজন লোক এসে আমায় জিগেশ করে গেলো যে আমেরিকায় প্রথম পুজো কেমন লাগছে।
সৌজন্যবিনিময়ের ফাঁকে জানতে চাইলাম "আচ্ছা সোমকদা, সবাই কি করে বুঝে যাচ্ছে যে আমেরিকায় এটা আমার প্রথম পুজো? এখানে কি সবাই সবাইকে চেনে?"
সোমকদা বোঝালো "ভালো করে আসে পাশে দেখ, পোশাক দেখে বুঝেছে "
এতক্ষন ভালো করে লোকজন কে দেখিনি। এবারে ভালো করে দেখলাম যে ছেলেরা সবাই ধুতি পাঞ্জাবি বা শেরওয়ানি পরে এসেছে, মেয়েরা সবাই খুব জমকালো শাড়ী পরিহিতা । আমি একমাত্র নতুন জিন্স আর নতুন টিশার্ট পরে 'হংস মাঝে বক যথা' হয়ে বসে আছি।
সোমকদা কে জিগেশ করলাম "আমেরিকায় এসে কি লোকজন বেশি বাঙালি হয়ে যায়? কলকাতার পুজোয় তো দেখতাম যে লোকজন যত পারছে ওয়েস্টার্ন জামাকাপড় পরে ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছে। অষ্টমী র অঞ্জলি ছাড়া তরুণীদের কখনো শাড়ী পড়তে দেখিনি কলকাতার পুজোয়।"
সোমকদা উদাসীন হয়ে বললো " নারে, বাঙালিরা বাঙালি থাকে চিরকাল। কলকাতায় ওরা ওয়েস্টার্ন  পরে স্টাইল দেখায়, আর ওয়েস্টার্ন দেশ এসে এরা সব ইন্ডিয়ান জামাকাপড় এর কম্পেটিশন করে"
তারপরে আরো যোগ করলো " আর তাছাড়া ভেবে দেখ, দেশে থাকলে মহিলারা গয়না আর শাড়ী দেখানোর জন্য বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি সুযোগ পায়। এখানে পুজো ছাড়া কোথায় এইসব কম্পেটিশন করবে?" 

হঠাৎ করে সোমকদা একজন তরুণীর সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। পরে জানলাম ওর নাম কৃষ্ণা, আগে একসঙ্গে চাকরি করতো ওরা।
শুনলাম সোমকদা বলছে  "বঙ্গসম্মেলন তোর নাচের প্রোগ্রাম টা দেখলাম, খুব সুন্দর হয়েছে"
কৃষ্ণা খুব খুশি কিন্তু বিনয় করে বললো "ওই আর কি, দেশ ছাড়ার পরে তো আর চর্চা হয়না, কোনোমতে উৎরে গেছে "
সোমকদা নাছোড়বান্দা "না রে, খুব ভালো হয়েছে, চালিয়ে যা। চর্চা ছাড়িস না "
কৃষ্ণা আরো বিনয় আর হতাশা মিশিয়ে বললো "কোথায় আর সুযোগ পাই বোলো। পরের বছর বঙ্গসম্মেলন তো কানাডা তে হচ্ছে, এদিকে ফেরত আসবে আবার বছর পরে "
সোমকদা বললো "তুই কি বঙ্গ সম্মেলন ছাড়া নাচতে পারিস না নাকি? এইতো আমাদের পুজো হচ্ছে, এখানে করছিস না কেন?"
কৃষ্ণা মুচকি হেসে জিগেশ করলো " তুমি এবছর আমাদের পুজোর ফোটোগ্রাফি করছো না কেন?"
সোমকদা একটু গম্ভীর হয়ে বললো "ওই আগের বছর ইন্দ্রানীদির ছবির ব্যাপারটা হয়েছিল না? তাই এবছর রক্তিম দা আমাকে ফটোগ্রাফির ডিউটি দেয়নি "
কৃষ্ণা একটু হাসি দিয়ে বললো "আমার ওই জন্মদিনের ব্যাপারটা হয়েছিল না? তাই আমিও এবার কালচারাল প্রোগ্রাম থেকে বাদ"
কৃষ্ণা চলে যাওয়ার পরে চেপে ধরলাম। "এই সোমকদা , এই ইন্দ্রানীদি আর রক্তিম দা, এরা করা? আর কি এমন আপত্তিজনক ছবি তুলেছিলে তুমি যে তোমাকে ফোটোগ্রাফি থেকে বাদ দিলো??"
সোমকদা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললো " রক্তিম দা হচ্ছে আঁখি দির হাসব্যান্ড।  আঁখিদি আর ইন্দ্রানীদি কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। আগেরবার ইন্দ্রানীদির একটা খুব ভালো ফটো তুলেছিলাম। প্রচুর লাইক এসেছিলো ওই ছবিতে।আঁখিদির ফটোতে অতগুলো লাইক আসেনি। সেই রাগে রক্তিম দা আমায় বাতিল করলো"
একটু অবাক লাগলো, তাও জিগেশ করলাম "আর ওই জন্মদিনের কেস টা কি?"
সোমকদা একটা মুচকি হাসি দিলো "কৃষ্ণার ছেলের ১ম জন্মদিন ছিল, মনে হয় অগাস্ট এর শেষের দিকে একটা মঙ্গলবারে। আঁখি দি অনেকবার করে বলেছিলো জন্মদিনের পার্টি টা পিছিয়ে দিয়ে সেপ্টেম্বর এর একটা রবিবারে করতে"
আরো অবাক লাগলো "কেন? জন্মদিন পিছিয়ে দিতে বললো কেন?"
"মঙ্গলবার করে আঁখিদির মেয়ের নাচের ক্লাস থাকে। তাই মঙ্গলবার হলে আঁখিদি আসতে পারবে না। তার পরের দুটো উইকেন্ড আঁখিদির অন্য নেমন্তন্ন ছিল। তাই পিছোতে বলেছিলো"
আসতে আসতে ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছিলো "বুঝলাম, আর কৃষ্ণা নিশ্চই ছেলের ১ম জন্মদিনটা দিনের দিনেই করেছে?"
"ঠিক তাই। আঁখি দি ছাড়া বাকি সব মহিলারা সেখানে গেছে, হৈহৈ করেছে। সেইজন্যই এবার কৃষ্ণা কে কোথাও নাচ করতে দেয়া হয়নি"
এইসব পলিটিক্স ঠিক মাথায় ঢুকছিল না "কিন্তু এই রক্তিমদা আর আঁখিদি দুজনে মিলে কি করে সব কিছু decide করে ? কখনো কোনো কমিটিতে তো এক ফ্যামিলি থেকে দুজনকে রাখতে দেয়া হয়না। এটাতো সোসাইটি এক্ট বা কমিটি এক্ট এর বেসিক নিয়ম"
সোমক দা একটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো "ধুর কোন জগতে যে তোরা থাকিস! রক্তিম দা বড়োসড়ো বাড়ি কিনেছে, পুজোর পরে রক্তিমদার বেসমেন্ট প্রতিমা থাকে। তাই রক্তিমদার কথাই এখানে ফাইনাল। ছোটবেলায় মনে নেই, পাড়ার ক্রিকেট খেলা? যে ব্যাট নিয়ে আসে সেই ক্যাপ্টেন হয়, তাকে আগে ব্যাট করতে দেয়া হয়, তাকে দুতিনবার আউট না হলে কেউ আউট বলে না? ধরে নে অনেকটা সেইরকম ব্যাপার"

ক্রিকেট এর লজিক টা মাথায় ঢুকলোঅবাক লাগলো  কিন্তু এখানে যে প্রতিমা বিসর্জন হয়না, বেসমেন্ট বন্দি হয়, সেটা জেনে আরো অবাক লাগলো। আরো অনেক নতুন নতুন জিনিস দেখে অবাক হতেই থাকলাম। হাজার হোক, আমেরিকার প্রথম পুজো বলে কথা। দেখলাম এখানে কলকাতার মতো ঠাকুর দেখার তাড়া নেই। দুদিন ধরে সবাই বসে আড্ডা গল্প দিয়ে খাওয়া দাওয়া  করে নাচ গান ইত্যাদি অনুষ্ঠান দেখে পুজো পালন করে। আড্ডা ব্যাপারটা খুব কৌতুকময় লাগলো।
দুদিন ধরে বেশিরভাগ ছেলেদের আড্ডা র বিষয় দেখা গেলো "সৌরভ গাঙ্গুলি টিমে কবে ফিরবে", "দ্রাবিড়ের ক্যাপ্টেন্সি বেশিদিন টিকবে নাকি কংগ্রেস সরকার বেশিদিন টিকবে" এই সমস্ত বিষয় নিয়ে। এছাড়া সবাই দেখলাম RECESSION বলে একটা শব্দ নিয়ে খুব চিন্তিত। চিন্তার প্রধান  বিষয় যে "RECESSION হলে দেশে ডলার পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যাবে নাকি কম টাকা পাওয়া যাবে", আর "RECESSION হলে আমেরিকায় ইলিশ মাছ আর স্কচ এর দাম বাড়বে নাকি কমবে "এই সব নিয়ে।
মেয়েদের আড্ডার বিষয় দেখা গেলো অপেক্ষাকৃত সহজ। প্রথমত যেই বান্ধবীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছে, সেই বান্ধবীদের ও তাদের সাজ পোশাক গয়না, স্বামী আর সন্তানদের প্রশংসা করা। দ্বিতীয়ত যেই বান্ধবীরা উপস্থিত নেই, কিংবা পুজোয় আসেনি, সেই বান্ধবীদের ও তাদের সাজ পোশাক গয়না, স্বামী আর সন্তানদের নিন্দা করা।

পুজোর শেষে মেয়েদের সিঁদুর খেলা এবং ছেলেদের কোলাকুলির সঙ্গে একে অপরকে জ্ঞান দেয়ার পর্ব চলতে থাকে।
রক্তিম দার মতো কয়েকজন গৃহস্বামী বাকিদের বলে "কি রে, আর কতদিন এইরকম বাড়ি ভাড়া গুনবি, এবারে একটা বাড়ি কিনে ফেল"
এই ভাড়াটে রা আবার বাকিদের জ্ঞান দেয় "আর কতদিন দেশি কোম্পানিতে কাজ করবি? এবারে একটা লোকাল প্রোডাক্ট কোম্পানি তে ঢুকে যা "
দেশি কোম্পানির কর্মচারীরা আরো নতুনদের জ্ঞান দেয় "কি করছিস? গ্রীন কার্ড টা এপলাই কর এবারে, আর কতদিন ভিসা নিয়ে বসে থাকবি?"
ভিসাওলারা আর কি করে ? আরো আনকোরাদের ডেকে বলছে যে "আর কতদিন বাস এ করে ঘুরবি? লাইসেন্স টা কর, গাড়ি কেন একটা"
আমি তো সবচেয়ে নতুন, আমার কিছুই বলার নেই। আমি তাই মা দুর্গার সামনে গিয়ে হাত জোর করে বললাম "মা গো, এইসব কি আসছে বছর আবার হবে?"


6 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো। ভীষণ প্রাণবন্ত ও ঝকঝকে লেখা। আমেরিকার বাঙালি সম্প্রদায়ের চমৎকার লিপিবদ্ধকরণ।
    আরও কিছু পাবার আশায় রইলাম। 👍👍

    ReplyDelete
  2. আহা আহা।। ব্রেভো ব্রেভো।। আমেরিকার প্রথম পুজোর কথা মনে পড়ে গেল।

    ReplyDelete
  3. Tor chokh diye bidesher pujo dekhe fellam. Okhane giye tor bangla dekhchi are pokto hoeche. Darun hoeche. Carry on.

    ReplyDelete
  4. বেশ লাগলো গল্প টা। আমার বন্ধুদের থেকে শুনেছি এরম এ কিছু হয় ববিদেশে পুজো তে। কিন্তু যারাই পড়ছেন, দুঃখ পেয়ে দেশে ফিরে আসবেন না যেন। এখানে এসব র চেয়ে অনেক বড় বড় বেদনা রয়েছে। যেভাবে ছেড়ে গেছিলেন কয়েক বছর আগে, সে দেশ আর নেই 'মিত্র'

    ReplyDelete

বিদেশে বাণী বন্দনা

  প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় ...