সূর্য্য
প্রবাসী বাঙালিদের সরস্বতী পুজো করার উদ্দেশ্য (আর বিধেয়) নিয়ে প্রায়ই নানান আলোচনা হয়ে থাকে। প্রথম কথা এটা আঞ্চলিক প্রথা, যা কিনা দোলযাত্রা, স্বাধীনতা দিবস বা দীপাবলির মতো সারা ভারতে অনুষ্ঠিত হয়না । তাছাড়া এখানে তো আর স্কুল কলেজে সরস্বতী পুজো হয়না, যে ছোটরা দায়িত্ত্ব নিয়ে একটা পুজোর আয়োজন করবে । তাহলে আমরা, এই মাঝবয়েসী সম্প্রদায় কেন বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে সরস্বতী পুজো করি? অনেকেই বলবেন যে সরস্বতী পুজো হচ্ছে বাঙালিদের ভ্যালেন্টাইন্স ডে । তাই আমরা সরস্বতী পুজো করে ছোট বেলার স্কুল জীবনের ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন এর স্মৃতি রোমন্থন করি । কথাটা আমি বিশ্বাস করি না । ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করতে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রেম , সেটা বেশিরভাগ বাঙালির কপালেই জোটে না । অন্তত স্কুল জীবনে সরস্বতী পুজো করার বয়েসে জোটে না । যদি জুটতো তাহলে নীলাঞ্জনা, বেলা বোস কিংবা সুকান্ত জাতীয় বিরহের গান এতো জনপ্রিয় হতো না । বাঙালিদের নিয়ে বলা হয় "জন্ম থেকে সেন্টু খেয়ে শহীদ শহীদ ভঙ্গি, গুলির আগেই সারেন্ডার আর প্রেমের আগেই লেঙ্গি"। তাই বাঙালিদের বেশিরভাগ ক্রাশ গুলো প্রেমে পরিণত হওয়ার আগেই crushed হয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন্স ডে অবধি গড়ায় না ব্যাপারটা । তাই সরস্বতীপুজোর নাম করে আমরা ছোটবেলার ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করার স্মৃতি রোমন্থন করছি, এই যুক্তি টা দু -পাঁচ জনের জন্য হতে পারে, সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য হতে পারে না।
এবারে হয়তো অনেকেই বলবেন যে শুধু সরস্বতী পুজো কেন, আমরা বাঙালিরা যেকোনো পুজো বা যেকোনো অনুষ্ঠান করি সেলফি তোলার জন্য । অনুষ্ঠান মানেই সেখানে প্রচুর সুন্দরীর সমাগম হবে, এবং তারপরে সেই সুন্দরীদের সুন্দর সুন্দর সেলফি স্মার্ট ফোন এর মাধ্যমে ছড়িয়ে যাবে ফেইসবুক আর ইনস্টাগ্রামে , এবং ক্রমশ সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শহর আর বিভিন্ন গ্রামে । সেলফি ব্যাপার টা আজকাল এতটাই ভাইরাল হয়ে গেছে , কয়েকদিন পরে হয়তো স্কুল এর পরীক্ষায় লিখতে দেবে , বলো সেলফি কয় প্রকার ও কি কি ? উত্তরে লেখা হবে যে সেলফি ৩ প্রকার। সুন্দরী শুধু নিজের ছবি তুললে সেটা সিঙ্গুলার সেলফি , বান্ধবীদের সঙ্গে হলে সেটা plural সেলফি , আর স্বামীর সঙ্গে হলে সেটা অপশনাল সেলফি। এই অপশনাল সেলফি কেন অপশনাল, কোন কোন পরিস্তিতি তে স্বামীরাও সেলফি তে ঢুকতে পারেন, সেই কারণ বা লজিক খুঁজতে যাবেন না । সেটা "দেব না জানন্তি ক্যূত মনুষ্যায় " । শুধু এইটুকু জেনে নিশ্চিন্ত থাকুন, যদি আপনার স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি নেয়ার সৌভাগ্য হয়ে থাকে, তাহলে আপনি ভাগ্যবান। যদি স্ত্রীর সঙ্গে সেলফি তোলার সৌভাগ্য হয়নি, তাহলেও আনন্দে থাকুন, কারণ আপনি একা নন, আপনি একটা সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের সদস্য । কিন্তু আজকের যুগের ধর্ম যাই হোক,মনে রাখতে হবে যে একটা সময় ছিল যখন ফেইসবুক ছিল না, স্মার্টফোন ছিল না, সেলফি ও ছিল না, কিন্তু তখনও সরস্বতী পুজো হতো । তাই শুধুমাত্র লোক দেখানো ছবি তোলা নয়, সরস্বতী পুজোর এই কালজয়ী প্রথার পেছনে নিশ্চই আরো গভীর কোনো কারণ আছে । কি সেই কারণ? কেন আমরা বাঙালিরা সরস্বতী পুজো করি ?
সরস্বতী পুজো হয় মাঘ মাসে , মাঘ মাসের পরেই আসে ফাল্গুন মাস আর সেই সঙ্গে আসে অ্যানুয়াল পরীক্ষা কিংবা বোর্ড এর পরীক্ষা । মা সরস্বতী বিদ্যার দেবী । ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্ট হোক কিংবা লাস্ট, জীবন প্রেমপূর্ণ হোক বা প্রেমশূন্য , পরীক্ষার আগে মা সরস্বতীর আশীর্বাদ নিতে কেউ পিছপা হয় না । সেইজন্যই আমরাও সবাই ছোটবেলায় "বিদ্যাং দেহি নমস্তুতে" বলে পুষ্পাঞ্জলি দিতে যেতাম ।
বিদ্যার দেবী প্রসন্ন হয়েছিলেন বলেই আজকাল বিভিন্ন দেশে এতো প্রবাসী বাঙালি দেখা যায় । কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ হয়তো উচ্চপদস্থ চাকরির জন্যই বিদেশে আবির্ভূত হয়েছেন । আর দেবী সরস্বতীর অবদান ভুলতে পারেননি বলেই আজও দেবীর পুজো করেন । কিন্তু তার মানে কি বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতি শিক্ষিত হতে চায় না? অন্য কোনো জাতি কি পড়াশোনা করে না? নিশ্চই করে । ভারতের কিছু রাজ্য আছে, যেখানে লোকজন বলেন "ছেলেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে যাতে বিদেশে গিয়ে ডলার কামাতে পারে" , কিছু লোকজন বলেন "মেয়েকে MBA পড়াবো যাতে Mumbai তে ফ্লাট কিনতে পারে" । কেউ কেউ বলেন " আইএএস করতে হবে, তবেই ডজন খানেক লোক এর সেলাম পাওয়া যাবে" । অনেকেই বলবেন যে এগুলো দার্শনিক কথাবার্তা। টাকা উপার্জন করা, কিংবা খ্যাতি উপার্জন করা কি ভুল? কখনোই নয়। এইজন্যই আমরা বাঙালিরা ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো আর সরস্বতী পুজো, দুটোই করি। জীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতি যেরকম দরকার, সেইরকম সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তিও দরকার। কিন্তু এই দুটো দরকারকেই আলাদা করে গুরুত্ব দেয়া উচিত, একটা দিয়ে অন্যটাকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত না।
এইজন্যই বাঙালিরা শিক্ষালাভ কে অর্থ লাভ বা প্রতিপত্তিলাভ এর মার্গ ভাবেন না, শিক্ষা কে শুধুমাত্র শিক্ষার মতো করেই সম্মান জানান । অন্তত আমাদের ছোটবেলায় বাঙালি ঘরে ঘরে তাই হতো। যখন কোনো স্কুল এর হেডমাস্টার ফতুয়া লুঙ্গি আর চপ্পল পরে বাজার করতে যেতেন, পাড়ার দোকানদার বা বাচ্ছারা তাঁকে প্রণাম জানাতো । সরস্বতী পুজোর দিন প্রার্থনা করার সময়ে আমরা কখনো বলিনি যে "মা, এমন বিদ্যা দাও মা, যাতে ডলার কমাতে পারি, এমন বিদ্যা দাও মা যে মুম্বাই এর মধ্যভাগে ফ্লাট কিনতে পারি" । তখন বাঙালিদের ঘরে এক দেয়ালে পাশাপাশি ঠাঁই পেত রবিঠাকুর আর বিদ্যাসাগর মশাই এর ছবি । আমরা ওনাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য কে গুরুত্ত্ব দিতাম না, শ্রদ্ধা জানাতাম ওনাদের শিক্ষা আর সংস্কৃতি কে । যতদিন বাঙালিদের মনে শিক্ষা বা সংস্কৃতির জন্য এই সম্মানটা থাকবে, ততদিন বাঙালিরা সরস্বতীপুজো চালিয়ে যাবে, সে প্রবাসী বাঙালি হোক বা বঙ্গবাসী । ভুললে চলবে না, একজন বাঙালি বলেছেন "টাকাপয়সা এমন একটা জিনিস, শিক্ষিত মানুষের হাতে পড়লে তার নাম 'অর্থ' , আর অশিক্ষিতের হাতে পড়লেই অনর্থ! "
That's deep...
ReplyDeleteIt's a masterpiece indeed. An excellent write-up summarizing a particular Bengali culture. Keep writing.
ReplyDelete