পৃথিবীর বাকি সাধারণ মানুষের চেয়ে ব্যতিক্রমী আমি একেবারেই নই , আর তাই যথাযত নিয়ম মেনে শীতের ভোরের ঘুমটা আমার ভীষণ প্রিয়
. কিন্তু উপরে ওই আছেন একজন যিনি
চোখের নিমেষে
ছড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাধাকে মানুষ করছেন মানুষকে গাধা , তারই আজ্ঞায় সকল
মায়া কাটিয়ে নিয়মমাফিক সকাল সকাল ওঠাটা এখন আমার রুটিন এ দাঁড়িয়েছে
আর কি ….
এই সব লেখা দেখে ভাববেন না যে আমি ভোর চারটেয় উঠে প্রাকটিস করতে যাই নেক্সট বছরে যাতে অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল পেতে পারি বা ওই টাইপ র কিছু
.. ওই যে বললাম নিতান্ত সাধারণ আমি .. বাকি আর পাঁচ জন ছাপোষা চাকুরীজীবির মতন আমিও সকাল সকাল 9-5 টার অফিস করি
.. থুড়ি এখানেই ব্যতিক্রম
.. আমি ৭
- ৪ টা অফিস করি
.. আর তার জন্যেই এতো ভনিতা আর কি
..
ওই ৭ টার সময় অফিস পৌঁছানো টা আমার কাছে একরকম “আমাজন অভিযান
” থেকে কম কিছু নয়..
(আজকাল
এর খুব চর্চা তো তাই মেনশন করেই দিলাম
) ৫ বার অ্যালার্ম snooze করে , ছেলেকে ঘুম না ভাঙিয়ে কায়েদা করে ঘাড় থেকে নামিয়ে গরমগরম লেপ (গরম লুচির চেয়ে কিছু কম মধুর নয়)
সরিয়ে বিছানা থেকে কোনোক্রমে ভূতলে অবতীর্ণ হবার পরমুহূর্তেই realize করা যে আলস্যির চোটে এবারেও যথারীতি প্রচন্ড late করে ফেলেছি আর তারপরেই টর্নেডোর মতন next ১৫ মিনিট এ ব্রাশ , ব্রেকফাস্ট
, চান আর পুজো করেই পড়ি কি মরি করে বেরোনো কি কম ঝক্কির কাজ
.. এখন এই এতো অল্প সময়ে এতো কিছু ঠিক কি ভাবে করি বা কতটা সুষ্ঠু ভাবে করি এসকল প্রশ্ন নাহয় ‘হেহে
’ উহ্হ্যই থাক
… কেউকেউ অবশ্য আমার এই fast forward পুজোর ব্যাপারে অত্যন্ত ক্রোধ প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু তাদের জন্য
বলি বিশ্বাস করুন , পরবর্তী আধ ঘন্টা আমি ভগবানেরই
নাম করতে করতে যাই সারা রাস্তা ধরে
..
কারণটা বলি
.. ছোটবেলাতে দিদির সাথে একটা খুব শখের খেলা ছিল … মুখ থেকে এক অদ্ভুত পক্রিয়া তে ভ্রুম ভ্রুম শব্দ করে হাতে একটি থালাকে প্রচন্ড বেগে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সারা ঘর দৌড়েবেড়াতাম
… ও ছিল আমার গাড়ি চালানো
.. গাড়ির বেগ বাড়লে থালা ঘোরার গতি ও বাড়তো
.. তখন বাড়িতে গাড়ি ছিল না এবং নিজের বাহ্যিক জ্ঞান বৃদ্ধির প্রয়াস বিশেষ না
থাকায় কোনোদিন সেভাবে জানা হয়নি এই বস্তুটি চলে কিভাবে
.. তবে খেলতে প্রচন্ড আনন্দ পেতাম এবং কোনো কোনো বন্ধুর নিকটে জিনিসটি কাল্পনিক নয়
মনে হলেই ঈর্ষা করতেও পিছপা হতাম না
| তবে বলা বাহুল্য, এসকল স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার কোনো প্রচেষ্টাই
ছিল না .. কিন্তু ভাগ্যক্রমে বড়ো হয়ে যখন জানতে পারলাম আমার হবু বরটির একটা বেশ সুন্দর বড়োসড়ো গাড়ি আছে তখন এককথায় বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম আর কি
..
বিয়ের প্রথমদিকে শুধু ইচ্ছা প্রকাশ করলেই কাজ হতো
.. অমনি পতিদেব চার চাকার ওই বস্তুটি চালিয়ে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতেন এবং অত্যন্ত খুশি মনে বলতেন গাড়ি চালানো তার বড়োই প্রিয় এবং তিনি সারা দিন রাত চালিয়ে পৃথিবীর এপার থেকে ওপর পর্যন্ত পারি দিতে পারেন
..
ধীরেধীরে বিয়ের কিছু বছর পর বোঝা গেলো ড্রাইভিং প্রিয় হলেও অতটাও প্রিয় ঠিক নয় এবং আমার পতিদেব ও ঠিক আমারি মতন অত্যন্ত নিদ্রাপ্রেমিক . তবে পত্নী প্রেমে কোনো ঘাটতি ছিল না কারণ আমরা ততদিন আবিষ্কার করে ফেলেছি ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম
’ মানে ওই দুজনেই ঘুমোতে ভালোবাসি . কোনোকালে আমাকে কোনো এক মহান ব্যক্তি বলেছিলেন যে একটিমাত্র বাক্য - “আমার বৌ ঘুমোচ্ছে” তে নাকি একইসঙ্গে শান্তি
, স্বস্তি , নীরবতা
, আনন্দ , সুখ ও খুশির অনুভূতি আছে
.. তাহলে আপনারাই ভেবে দেখুন “বর
ও বৌ দুজনেই ঘুমোচ্ছে
” এই অনুভূতি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন
..
আসল কথায় ফিরে আসি তবে
.. প্রথমদিকে আমি আমার ড্রাইভার থুড়ি পতিদেবের সাথে দিব্যি এদিক ওদিক গায়ে হওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং তখন ও বুঝিনি বস্তুটি চলে কিভাবে তবে এটুকু বুঝেছি ওই থালার মতন বস্তুটি কেবল দিক নির্দেশনা করে
.. প্রধান ভূমিকা তার মোটেও নেই
…. আমার বর
টি অত্যন্ত অবহেলায় প্রেমালাপ করতে করতে গাড়ি চালাতেন অতএব আমি ভাবিনি এর জন্যে কোনো বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন আছে … মনেমনে ভাবতাম যেদিনই মনে হবে চালাবো , সেদিন বসে গাড়িতে স্টার্ট দেব এবং বস্তুটি চলতে শুরু করবেন আমার গন্ত্যবস্থলের দিকে কারণ এতো অটোমেটিক গাড়ি
.. কতটা অটোমেটিক সে সম্পর্কে ধারণা নিতান্তই কম এবং আগেই বলেছি
.. অজানাকে জানার প্রয়াস আমার চিরকালই কম
… কখনো আমার পতিদেব দূর যাত্রায় নিমরাজি হলেই ভাবতাম উনি নিতান্তই অকর্মন্য
.. 7-8 ঘন্টা একটানা গাড়িই তো চালাবেন
..Dinosaur এর পিঠে তো বসতে বলিনি
.. নেহাত এটি চালানোর জন্যে আমার লাইসেন্স হয়নি তাই নয়তো কি ওনাকে এতো সাধতে হতো
..
তবে বলে না , সময় মানুষকে আসল শিক্ষা দেয়
.. আমাকেও দিলো
.. ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে আমার তো যাকে
বলে ল্যাজে
গোবরে অবস্থা .. কয়েকটি বার ফেল
টি করে ঘায়েল হয়ে .. না ভুল ভাবছেন
.. আমি থামিনি … লাইসেন্স টি শেষমেশ জোগাড় করেছিলাম
.. কিন্তু ততদিনে বুঝে গেছিলাম এ বিশেষ বস্তুটির মর্ম
.. এবং আমার যাওয়া আসা আমি নিকটবর্তী পরিচিত স্থানগুলির মধ্যেই সীমিত রেখেছিলাম
..
কিন্তু ওই যে বলে ঠেলার নাম বাবাজি
.. ভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমার চাকুরীস্থলটি আমার বসথান থেকে ২৬ মাইল দূরে অত্যন্ত জনবহুল ফিলাডেলফিয়া নামক একটি শহরে স্থানান্তরিত হলো
.. এবারে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমার পুজোর উদ্দেশ্য .. সকাল সকাল অটোমেটিক গাড়িতে স্টার্ট দেওয়া মাত্রই আর কিছু অটোমেটিক হোক না হোক
, আমার ভক্তিভাবটি ঠিক অটোমেটিক্যালি জেগে ওঠে
.. মনে হয় , হে ভগবান এ মায়ার বন্ধন থেকে আমায় মুক্ত করো
..সন্ন্যাসী হলে আর যাই হোক গাড়ি চালাতে তো হতো না
.
তবে সকল এডভেঞ্চার শেষে কিছু প্রাপ্তি থাকে
.. আমারও অবশ্যই আছে বৈকি
.. প্রচন্ড জনবহুল বড়ো রাস্তাটিকে পার করে গাড়িটিকে নিয়ে টুকটুক করে যখন ফিলাডেলফিয়া ব্রিজ উঠি তখন ভোরের আলো ফুটে ওঠে ধীরেধীরে আর আমাদের সুজ্জিবাবু ঠিক সেই সময়টিতেই নিজের আলস্য ছাড়িয়ে কুয়াশা নামক লেপটিকে সরিয়ে হালকা করে ফিলাডেলফিয়ার বুকে যখন উঁকি মারে , তখন আমার ছোট্ট ছেলেটার মুখটা বড্ডো মনে পরে যাকে অতি সন্তর্পনে আমার থেকে সরিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলে চলে এসেছিলাম সক্কাল সক্কাল …. আকাশের ওই লাল আভার
ওম ছড়িয়ে পড়তেই মনে হয় যেন
সদ্যঘুম ভাঙা চোখে সে আমায় দুটো ছোট্ট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদো আদো গলায় আমার কানে ঢেলে দিচ্ছে জীবনমন্ত্র
.. দুজনেই কেমন একাকার হয়ে যায় আমার কাছে , কেমন এক মায়ার জালে আবার জড়িয়ে পড়ি ধীরে ধীরে .. ওদিকে সুজ্জিবাবু আমার সকল সংশয় দ্বিধা দুশ্চিন্তা কে একনিমেষে দূর করে নিয়ে আসে অসামান্য এক সুপ্রভাত
..
No comments:
Post a Comment