বন্ধুরা আমাকে
বাংলার বাঘ বলে ডাকে, যদিও আমার নাম আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নয় । আমি পেশায় একজন সফটওয়্যার
ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে চাকরি করি, বছরে বা দুবছরে একবার করে দেশে আসি, আর বন্ধুদের সঙ্গে
বাংলা সংস্কৃতি ও বাঙালি ঐতিহ্য নিয়ে জ্বালাময়ী আলোচনা করে থাকি। বলা বাহুল্য, সেইজন্যই
বন্ধুরা আমায় বাংলার বাঘ নামটা দিয়েছে ।
এইরকম একবার
কালীপুজোর সময়ে ছুটি নিয়ে কলকাতা এসেছি । ভাইফোঁটার সন্ধ্যে, গিন্নি তার বাপের বাড়ি
গেছে ভাইবোনদের সঙ্গে ভাইফোঁটা পালন করতে। আমি আমার মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাটে বন্ধুদের
সঙ্গে আড্ডা দিয়ে চাইনিজ খাদ্য এবং বিলাতি
পানীয় সহযোগে যথারীতি আমাদের বাংলা সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব বোধ করেছি । দশতলা
ফ্লাট এর বারান্দায় দাঁড়ালে সেখান থেকে কলকাতার ধুলো, দূষণ, আবর্জনা, কিছুই বিশেষ চোখে
পড়েনা, বরং হেমন্তকালের শীতল বাতাসে আলো ঝলমলে শহরটা তখন দেখতে বেশ সুন্দর লাগে । সেই
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে আমাদের বাঙালি
সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। বন্ধুরাও রাত ৯
টার পরে যে যার বাড়ি চলে গেছে আর যাওয়ার পথে যথারীতি আমাকে আরেকবার 'বাংলার বাঘ' বলে
সম্মানিত করে গেছে ।
আমি সোফায় বসে
ভাবছি যে ঘুমাতে যাবো না টিভি দেখবো, হঠাৎ এইসময়ে কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে দেখি ধুতি
পাঞ্জাবি পড়া এক অমায়িক প্রৌঢ় । এক গাল হেসে বললেন যে "ওপরে যাচ্ছিলাম, যাওয়ার
পথে ভাবলাম দুটো কথা বলে যাই" । ভদ্রলোক কে ঠিক চিনতে পারলাম না, একটু সন্দিগ্ধ
দৃষ্টিতে ওনাকে দেখছিলাম,
উনি বোধহয় আমার মনের কথা টের পেয়েই বললেন "আমি তোমার
পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রায়ই তোমার আলোচনা শুনতে পাই, তাই ভাবলাম
দুটো মনের কথা বলে যাই"
আনন্দের সঙ্গে
ওনাকে ডেকে নিলাম ভেতরে, আমার জ্বালাময়ী আলোচনা শুনে উৎসাহিত হয়ে কেউ আমার সঙ্গে দেখা
করতে এসেছে, এর থেকে গর্বের আর কি হতে পারে? সোফায় বসতে
গিয়ে অবশ্য আরেকটা সন্দেহ মনের মধ্যে উঁকি দিলো, আমার পাশের ফ্ল্যাটে মিস্টার আগারওয়াল
থাকেন জানতাম, ইনি আবার কে ? রহস্যজনক ভাবে দেখলাম এবারেও আমার মনের কথাটা উনি জেনে
গেলেন।
আমায় জিগেশ করলেন যে "নিশ্চই ভাবছো যে পাশের ফ্ল্যাটে থাকি কিন্তু আলাপ হয়নি কেন
"
আমি অস্বীকার
করলাম না, "সত্যি আপনাকে আগে তো কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না "
উনি অমায়িক
হাসি দিয়ে বললেন "আমি কিন্তু তোমাকে অনেক বার দেখেছি, লিফ্ট এ , পার্কিং এ ,অনেকসময় মিস্টার আগারওয়াল এর পাশে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখেছি
ওনার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করতে "
একটু লজ্জিত
হয়েই বললাম, "আসলে আমি ঠিক খেয়াল করিনি হয়তো"
আবার একটা অমায়িক
হাসি " আরে লজ্জা পাচ্ছ কেন? খেয়াল করার কথাও না । মিস্টার আগারওয়াল রোজ স্যুট টাই পরে বাড়ি থেকে বেরোন, আধ
কোটি টাকার মার্সিডিস গাড়ি তে চড়েন, ওনাকে
চোখে পড়াটা স্বাভাবিক , আমার মতো ধুতি পাঞ্জাবি পড়া রিটায়ার্ড বাংলার মাস্টার কে আর
কে খেয়াল করে ?"
শ্লেষাত্মক এই বাক্যটা অব্যর্থ তীর এর মতোই বিবেকে এসে বিঁধলো, মনে পড়লো ছোটবেলায় রাস্তা ঘাটে কোথাও কোনো স্কুল এর মাস্টারমশাই বা
দিদিমনি কে দেখতে পেলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম । আজকাল বাংলার মাস্টারমশাই কে
আর হয়তো কেউ প্রণাম করে না, যত সম্মান, সব শুধু আগারওয়াল বাবুদের মতো স্যুট টাই পরা মানুষদের জন্যই । প্রসঙ্গ টা বদলানো দরকার ছিল, তাই কথা ঘোরানোর জন্য বললাম "আপনি
কি যেন বলছিলেন, আমাদের আলোচনা শুনতে পান মাঝে মধ্যে"
মাস্টারমশাই
উৎসাহিত হয়ে বললেন "হ্যা, এই যে তুমি বাংলা ঐতিহ্য সংস্কৃতি নিয়ে ভাব, কথা বার্তা
বলো, এটা শুনতে বেশ ভালো লাগে "
আর আমায় পায়
কে, সগর্বে ঘোষণা করলাম "আমরা তো আমেরিকাতেও
বাঙালি পার্টি করি, সবাই বাঙালি পোশাক পরে আসে, বাঙালি খাবার দাবার খায় , দারুন
জমজমাট ব্যাপার"
মাস্টারমশাই
মুচকি হাসলেন "পার্টি ব্যাপারটাই তো বিদেশী জানতাম, বাঙালি পার্টি ব্যাপারটা অনেকটা
সেই সোনার পাথরবাটি হয়ে গেলো না? "
আমি অত সহজে
হেরে যাওয়ার নই, আমিও বললাম যে দেখুন পার্টিটা তো হতোই, কিন্তু সেখানে আমরা বিদেশী
স্টাইল না করে বাঙালি স্টাইল করছি, সেটাও আমেরিকার মাটিতে বসে, এটা কি একটা ছোট ব্যাপার?"
মাস্টারমশাই
মাথা নাড়লেন "হ্যা, এটা তো খুব বড় ব্যাপার। তোমরা পার্টিতে বাঙালি পোশাক পড়ছো,
বাঙালি খাবার খাচ্ছো , কিন্তু পার্টিতে তোমরা কি বাংলায় কথা বলো? তোমরা কি বাংলা কে
নিয়ে কথা বলো?"
এবার একটু বিপদে
পড়লাম, কথাবার্তা তো বাংলা কে নিয়ে হয়না, বেশিরভাগ কথা বার্তা হয় নেক্সট পার্টি কোথায়
হবে, কি মেনু হবে সেইসব নিয়েই । কিন্তু সেকথা
কি স্বীকার করা যায়?
আমি তাই বললাম যে "শুধু কি বাংলায় কথা বলি? আমরা সবাই খুব
সংস্কৃতিমনস্ক। ইনফ্যাক্ট আমাদের বেশিরভাগ বন্ধু ছুটি তে এসে একবার করে শান্তিনিকেতন
ও ঘুরে গেছে ।"
মাস্টারমশাই সরল মুখ করে জানতে চাইলেন আমার সংস্কৃতিমনস্ক বন্ধুরা
শান্তিনিকেতন এ গিয়ে কি কি সংস্কৃতিমনস্ক কাজ করে । আরো বিপদ , মাস্টারমশাইকে কি করে
বলি যে ওরা শান্তিনিকেতন যায় রিসোর্টে বা নদীর পাড়ে বসে মদ খাবার জন্য ? হাট থেকে ঘর
সাজানোর জিনিস কেনে সেটা বলবো? কিন্তু সেটাও তো খুব একটা সংস্কৃতিমনস্ক বলে চালানো
যাবে না।
মাস্টারমশাই
নিজেই বাঁচিয়ে দিলেন । "আসলে এই বাঙালি সংস্কৃতি ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে। সংস্কৃতি
শব্দটা কি থেকে এসেছে জানোতো ?"
আবার
আমি কমফোর্ট জোনে ফিরে এসেছি। সগর্বে বললাম
যে "সংস্কার থেকেই সংস্কৃতি "
মাস্টারমশাই
এইবারে একটু গা ঝাড়া দিয়ে বসলেন "সংস্কার মানে কি? আমাদের ছোটবেলায় বলা হতো সংস্কার মানে ব্যবহার,
শিক্ষা, মূল্যবোধ , আর আজকাল সংস্কার মানে চাকচিক্য আর বস্তুবাদ"
আমার চিন্তাধারা
একটু গুলিয়ে গেলো । আমেরিকায় বসে আমি বাঙালি সংস্কৃতির ঢাক পেটাচ্ছি, আর এদিকে কলকাতায়
বসে বাংলার মাস্টার বলছেন যে বাংলার সংস্কৃতির ভিত টা বদলে গেছে?
"বুঝলে
না তো? একটু সহজ করে বলি।" মাস্টারমশাই উৎসাহ নিয়ে যেন ক্লাস শুরু করলেন
"আমার স্ত্রী দারুন গান করে। যখন বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছিলো, শুনেছিলাম যে ও নাকি
গীতবিতানের সব গান জানে । ব্যাস, শুনেই আমাদের
বাড়ির সবাই বললো দেখো কি ভালো গান জানে মেয়েটা । এদিকে আমার মেয়েও খুব ভালো গান করে।
আজকাল যখন কাউকে বলি মেয়ে ভালো গান করে , কেউ জিগেশ করে না যে কটা গান জানে, কি রকম
গান জানে, সবাই জানতে চায় যে ইউটিউবে বা ফেসবুকে কটা গান আপলোড করা আছে, কটা লাইক কমেন্ট আর ফলোয়ার আছে। বুঝলে ভায়া, কাজের থেকে কাজের চাকচিক্য টা আজকাল
বেশি প্রাধান্য পায়।যেমন ধরো তোমরা সবাই এক কথায় বলে দিতে পারো যে মিস্টার আগারওয়াল
কিরকম স্যুট পরে কিরকম গাড়ি করে অফিস যান, কিন্তু কেউ কি এটা বলতে পারবে যে উনি কোন
অফিস যান, অফিস এ কি ধরণের কাজ করেন?"
কথাটা খুবই
সত্যি। শুধু ওনার গাড়ির সঙ্গে নিজের গাড়ির মনে মনে একটা তুলনাই করে গেছি, কোনোদিন জানার
চেষ্টা করিনি উনি কি কাজ করেন । যুক্তিতর্কের
আলোচনায় খুব একটা সুবিধে করতে পারছি না, শুনেছিলাম আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ পথ আক্রমণ। তাই
এবারে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলাম ।
"আজকাল যুগ পাল্টে গেছে । নিজের মার্কেটিং নিজেকেই
করতে হয়। তাই যুগের প্রয়জনেই বাঙালিরাও বদলাচ্ছে। চাকচিক্যের দিকে মন দিচ্ছে । রবিঠাকুর
নিজেই তো লিখেছিলেন যে জীবনের অপর নাম পরিবর্তন যে জীবনে পরিবর্তন নেই তা মৃত্যুর সমার্থক
"
মাস্টারমশাই
কিন্তু এই আক্রমণেও নির্বিকার। "পরিবর্তন ভালো, কিন্তু পরিবর্তনের সঙ্গে বিকৃতির
পার্থক্য টা বোঝা খুব দরকার। তুমি স্টাইল করার
জন্য কাণফুটো করে দুল পড়লে, সেটা পরিবর্তন। কিন্তু কানটাই যদি কেটে উড়িয়ে দাও, সেটা
বিকৃতি। সেইরকম, যদি ভালো কিছু বিদেশী সংস্কৃতি তুমি বিনম্র শ্রদ্ধায় আপন করে নাও,
সেটা পরিবর্তন। আর বাঙালি সংস্কার বিরোধী
কোনো জিনিস যদি তুমি সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মার্কেটিং করো, সেটা বিকৃতি। "
সব কিছু কিরকম
গুলিয়ে যাচ্ছিলো। সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সংস্কার বিরোধী কাজ করার ব্যাপারটা একেবারেই
মাথায় ঢুকলো না।
বাংলার মাস্টার
একটা রহস্যময় হাসি দিলেন। "তুমি তো তোমার দিদির খুব আদরের ছোট ভাই, তাই না?"
চমকে উঠলাম।মাস্টারমশাই কি সত্যি মনের কথা টের পেয়ে যান? উনি বললেন "তোমার পেছনের দেয়ালে তোমার আর তোমার দিদির
অনেক ছবি আছে দেখছি, তাই বললাম।"
আস্বস্ত হলাম,
"হ্যা ঠিক বলেছেন।কিন্তু কেন?"
বাংলার মাস্টার
আবার সেই রহস্যময় হাসি দিলেন "একটা কথা আমি বুঝলাম না, ভাইফোঁটার সন্ধ্যায় তুমি
দিদির বাড়ি না গিয়ে একাএকা ফ্ল্যাটে বসে নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য বন্ধুদের ডেকে পার্টি
করছিলে কেন?"
মাস্টারমশাই এর কথাটা খুব দুর্বল জায়গায় আঘাত করলো। দিদির
কাছে গিয়ে ভাইফোঁটা নেয়া টা আমার কাছে সত্যি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেখানেই থাকি না কেন কালীপুজো
ভাইফোঁটার সময়ে আমি কলকাতা আসতাম। কিন্তু গত কয়েকবছর হলো দিদি নতুন একটা চাকরিতে ঢুকেছে,
আর সেই অফিস এর অবাঙালি কলিগরা সবাই উৎসাহ নিয়ে ধনতরস পালন করে। ওদের সঙ্গে পাল্লা
দিয়ে কেনাকাটা না করলে নাকি দিদির প্রেস্টিজ থাকে না । তাই ইদানিং ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান
টা সংক্ষেপে সেরে ফেলেই দিদি ধনতরস এর কেনাকাটা
করতে দোকানে দৌড় দেয়। দিদি একসময় নিজে হাতে রান্না করে লুচি মাংসর লাঞ্চ থেকে পঞ্চব্যঞ্জন
ডিনার না খাইয়ে ছাড়তো না ভাইফোঁটার দিনে । আর সেই দিদি লাস্ট কিছু বছর দোকান থেকে অর্ডার
করা চাইনিজ কিংবা পিজা খাইয়েই ছেড়ে দিচ্ছে, কারণ বান্ধবীরা অপেক্ষা করে আছে ধন্তরস
শপিং এর জন্য। সেই থেকেই আজকাল ভাইফোঁটার সন্ধ্যে একাই কাটাই।
দুঃখের কথাটা
মাস্টারমশাইকে বলতেই হলো। মাস্টারমশাই মৃদু হেসে বললেন "এবার বুঝলে তো বাপু ,
তফাৎটা কোনখানে । পঞ্চব্যঞ্জন বাঙালি খাবার এর জায়গায় পিজা বা চাইনিজ খাওয়া টা পরিবর্তন,
সেটায় কিছু খারাপ নেই। কিন্তু এই পরিবর্তন এর পেছনে যে কারণটা, অর্থাৎ প্রিয় ভাইয়ের
মঙ্গল এর অনুষ্ঠানের জায়গায় লোকদেখানো শপিং করাটাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া, সেইটা তোমার
খারাপ লেগেছে। বিকৃতি বলে স্বীকার করো বা না করো, এটা তো মানবে যে লোকদেখানো আড়ম্বর
জিনিষটা বাঙালি সংস্কৃতি তে আগে ছিল না "
স্বীকার করতে
বাধ্য হলাম, কথাটা সত্যি। ছাত্রকে একটা কঠিন সাবজেক্ট বোঝানোর সাফল্যের হাসি দিয়ে বাংলার
মাস্টার বললেন "তাহলে এবার বলোতো ভাই, শুধু বাঙালি জামাকাপড় আর বাঙালি খাবার খেলেই
কি সেটা বাঙালি পার্টি হয়? নাকি ভেতরের চিন্তাধারাটা বাঙালি করা বেশি দরকারি?"
আমিও নাছোড়বান্দা "বাঙালি চিন্তাধারা
কি এমনি এমনি আসবে? আজকাল তো চারদিকে অবাঙালি সংস্কৃতি এসে বাঙালি সংস্কৃতিকে ঢেকে
দিচ্ছে। দোলপূর্ণিমা র দিন বাঙালিরা একে অপরকে হ্যাপি হোলি কিংবা হোলি মুবারক মেসেজ
করছে, চপ-সিঙ্গারা এখন পাকোড়া-সমসা হয়ে যাচ্ছে, লুচি হয়ে যাচ্ছে পুরি , পান্তুয়া হয়ে
যাচ্ছে গুলাব জামুন ; এগুলো আটকাতে হবে না? আমরা তো সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি বাঙালি
পার্টি করে "
বাংলার মাস্টার কিছু বললেন না, শুধু একটা হালকা হাসি দিলেন ।
আমি উৎসাহ পেয়ে আরো বলে গেলাম "আগেরবার
একটা বিয়েতে গেছিলাম, ঘোষ বাড়ির ছেলে আর সরকার বাড়ির মেয়ের বিয়ে। সেখানে হঠাৎ করে ঠিক
হলো যে সঙ্গীত অনুষ্ঠান করতে হবে অবাঙালিদের মতো। বেছেবেছে বিয়ের আগের সন্ধেতেই সেটা
হলো।গভীর রাত অবধি সেই নাচানাচির ফলে ছেলের মা এতো ক্লান্ত যে উনি বললেন আমরা বাপু
দধিমঙ্গল করি না, তাছাড়া অনেক ধকল যাবে কালকে , সবাই সকালে যতক্ষণ পারে ঘুমিয়ে নিক। আর মেয়ের মা তো সঙ্গীত এ নাচ করার চেষ্টা করতে গিয়ে
পা মচকে এমন কান্ড করলেন যা জামাই কে বরণ করতেও যেতে পারলেন না । এইসব বিকৃতি দূর করার
জন্যই তো আমরা বাঙালি পার্টি করি , এটলিস্ট একটা বাঙালি জনমত তৈরী হবে এই থেকে
"
মাস্টার মশাই
এবার নড়ে বসলেন "দেখো বাপু, সমস্ত সংস্কৃতির কিছু সুন্দর দিক আছে। আর বাঙালিরা
তো চিরকাল উদারমনস্ক। যদি অবাঙালিদের সংস্কৃতি থেকে আমরা কিছু ভালো জিনিস গ্রহণ করি
সেটা আমাদের উদারমনস্কতার পরিচয়। এই অবাঙালি সংস্কৃতি টা আসল সমস্যা নয়, সমস্যার একটা
প্রতিফলন মাত্র। আসল সমস্যা হলো যে বাঙালিরা
আজকাল আগেকার মূল্যবোধ টা হারিয়ে ফেলছে। যেহেতু অবাঙালিরা সাধারণত বাঙালিদের থেকে বেশি
আর্থিক ভাবে সচ্ছল হয়, তাই আজকের বাঙালিরা নিজেদের সচ্ছলতার পরিচয় দেয়ার জন্য অবাঙালি
সংস্কৃতি কে আঁকড়ে ধরছে। আমরা যে আজকাল মাড়োয়ারি পাঞ্জাবি বা মারাঠিদের কিছু সংস্কৃতি
আপন করে নিচ্ছি, সেটা শুধুই পরিবর্তন, সেটা বিকৃতি নয় । কিন্তু আমরা যে নিজেদের শিক্ষা,
রুচি, ব্যবহার, নীতিবোধের মাপকাঠিতে না মেপে তার জায়গায় আর্থিক প্রতিপত্তি বা সচ্ছলতার
মাপকাঠিতে মাপছি , সেইটা বিকৃতি। কারণ এটা সনাতন বাঙালি সত্ত্বার বিরোধী। "
একটু একটু করে
মাস্টারমশাইয়ের কথা গুলো মনে ঢুকছিল। "আগেকারদিনে বুঝি বাঙালিরা নিজেদের ঢাক পেটাতো
না ? নিজেদের প্রতিপত্তি বা সচ্ছলতার নিদর্শন করতো না?"
বাংলার মাস্টার
অতীতে ঢুকে গেলেন "তখনও ঢাক পেটানো হতো, তখনও পরনিন্দা পরচর্চা হতো, কিন্তু মাপকাঠিগুলো আলাদা
ছিল। আমাদের এক প্রতিবেশিনী খুব গর্বিত বোধ করতেন এই ভেবে যে শ্যামা সংগীতটা আমার স্ত্রীর
থেকে উনি বেশি ভালো গাইতে পারেন বলে।আর এদিকে আমার স্ত্রী গর্ব করতেন এই বলে যে প্রতিবেশী
ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক চারচাকার গাড়ি চালিয়ে অফিস
গিয়ে শুধুমাত্র মেশিন তৈরী করতেন , আর এদিকে আমি দুচাকার সাইকেল চালিয়েও কিন্তু
স্কুল এ গিয়ে ছাত্র তৈরী করতাম, দেশের ভবিষ্যৎ তৈরী করতাম । "
আমি অবাক হয়ে
গেলাম "মানে উপার্জন এর থেকে বেশি সম্মান ছিল গুনের ?"
মাস্টার মশাই
হাসলেন "খুব বোকা বোকা শোনাচ্ছে, তাই না? আমি অবশ্য আজকাল ইন্জিনিয়ার পাত্র খোঁজ
করছি আমার মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য। মেয়ে তো আরো এক কাঠি উপরে, মেয়ে আবার খোঁজ নেয় যে
কিরকম ইঞ্জিনিয়ার। তেল কালি মেখে ফ্যাক্টরি তে ঘুরবে, নাকি এসি ঘরে বসে কম্পিউটার চালাবে
নাকি বিদেশে গিয়ে পয়সা কামাবে"
আমি আপত্তি
না করে পারলাম না "এই কথাটা খুব প্রাকটিক্যাল কথা। শুধুমাত্র শিক্ষা, ব্যবহার,
নীতিবোধ এইসব দিয়ে সংসার চলে না, আজকাল টাকা
ছাড়া কিছুই হয় না। বাঙালিরা আজকাল অর্থ উপার্জন করতে চাইছে, এটা খারাপ কি? বাঙালি সমাজ
তো ধনী হচ্ছে। "
মাস্টার মশাই
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন "না হে না , যতই
অর্থ উপার্জন করছি, আমরা ততই দরিদ্র
হচ্ছি।"
"অর্থ
উপার্জন করে দরিদ্র হচ্ছি?"
"তা নয়তো কি? আমাদের সময়ে দুকামরার বাড়িতে আমরা
৫-৬ জনের পরিবার অনায়াসে থাকতাম। আজকাল ভালো চাকরি করলেই সবাই একটা বিশাল বাড়ি আর চকচকে
গাড়ি কিনে ফেলে, স্টেটাস দেখানোর জন্য। তারপরে
বাকি জীবন ব্যাঙ্ক এর লোন এর চাপে সিঁটিয়ে থাকে । আমাদের ছোটবেলায় বাড়ির দেয়াল এ মনীষী মহাপুরুষদের
ছবি থাকতো, বসার ঘরে বই এর আলমারি থাকতো স্টেটাস দেখানোর জন্য । আজকাল সমৃদ্ধিশালী
বাঙালিদের বাড়ি এতোই ছোট যে সেখানে মনীষী মহাপুরুষদের
জায়গা হয়না, বইয়ের আলমারির ও জায়গা হয়না। আমরা অর্থ উপার্জন করে আজকাল রেস্তোরায় গিয়ে
৫ হাজার টাকা দিয়ে খাবার খাই, সিনেমা হল এ গিয়ে ১ হাজার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখি, কিন্তু
তাও আমরা বাঙালিরা এতো গরিব যে ৫০০ টাকা দিয়ে একটা ভালো বই কিনতে আমরা ৫ বার ভাবি।
"
কথাটা অপ্রিয়
হলেও খুব সত্যি। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
শেষে ওনাকেই জিগেশ করলাম "কি উপায় আছে বলুন তো?"
বাংলার মাস্টার
একগাল হাসি দিলেন "উপায় তো তোমরা, যারা এখনো বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য
নিয়ে ভাবনা চিন্তা করো। কিন্তু , তোমাদের ভাবনাচিন্তা শুধু পোশাক, খাবার আর আচার আচরণেই
সীমিত রেখোনা, বাঙালিদের যেটা আসল পরিচয়, তাদের মুক্ত চিন্তা ধারা,নীতিবোধ, যেটা আসল
বাংলা সংস্কার সেইদিকে তোমরা মন দাও। অবাঙালিদের দেখো, বিদেশিদের দেখো, তাদের সংস্কৃতিতেও
কিন্তু পরিবর্তন আসছে, কিন্তু ওদের মূল নীতিবোধগুলো ওরা বদলাচ্ছে না। তোমরাও চেষ্টা
করে যাও যাতে বাঙালিরা নিজেদেরকে যেন ভুলে না যায়। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন - আত্মবিস্মরণ
মহাপাপ; তোমরা সেটা হতে দিয়ো না।"
চুপচাপ বসে
ঘাড় নাড়লাম। তাছাড়া আর উপায় ও ছিল না। হঠাৎই
দেয়ালের ঘড়িতে ১১ টা বাজার আওয়াজ হলো । মাস্টার
মশাই উঠে দাঁড়ালেন। "বকবক করে অনেক দেরি হয়ে গেলো, উপরে যাবো বলে বেরিয়েছিলাম
আর এর মধ্যেই ১১ টা বেজে গেলো। যাই হোক চলি এবারে " ।
মাস্টার মশাই
চলে গেলেন আর এদিকে আমি সোফায় বসে ভাবতে থাকলাম ওনার কথা গুলো। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে
পড়েছি খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙলো গিন্নির চেঁচামেচিতে। "কতবার করে তোমায় বলেছি যে সোফায় শুয়ে ঘুমাবে
না, কুশন গুলো খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু তুমি তো
কিছুতেই শুনবে না" ।
আড়মোড়া ভেঙে
উঠে দাঁড়ালাম, গিন্নি এদিকে বলেই যাচ্ছে "কি ঘুম রে বাবা, কুম্ভকর্ণ ও লজ্জা পাবে,
আধ ঘন্টা ধরে দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছি, আর ইনি ঘুমিয়েই যাচ্ছেন। ভাগ্গিশ আরেকটা চাবি ছিল
আমার কাছে। "
আরেকটা চাবি
থাকা সত্ত্বেও গিন্নি কেন যে আধ ঘন্টা দরজা ধাক্কাচ্ছিলো জিগেশ করতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু
সামলে নিয়ে বললাম "রাত ১১ টার পরে ঘুমাতে গেছি, তাই একটু দেরি হলো উঠতে
"
গিন্নি গর্জন করে উঠলেন "মিথ্যে বলো না, তোমার বন্ধুরা তো সবাই শুনলাম
রাত ৯টার সময়ে বেরিয়ে গেছিলো, তুমি নিশ্চই তখন থেকেই ঘুমাচ্ছ"
বাংলার মাস্টারকে মনে পড়লো, উনি ১১ টার ঘন্টা শুনে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি বললাম "পাশের ফ্ল্যাটের
মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিলাম, কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেছিলো"
গিন্নি একেবারে
রাগে টগবগ করে ফুটতে লাগলো, "মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পাওনা? তুমি মাস্টারমশাইয়ের
সঙ্গে গল্প করছিলে? যাও একবার বাইরে বেরিয়ে দেখ কি কান্ড হয়েছে। মাস্টারমশাই কাল রাত
৯টা নাগাদ হার্ট এটাক এ মারা গেছেন। করিডোর ভর্তি লোকজন, আর আমি পাশের ফ্ল্যাটে দরজা
ধাক্কিয়ে যাচ্ছি, কি লজ্জার ব্যাপার, আর এরমধ্যে ইনি আমাকে গল্প দিচ্ছেন যে রাত ১১
টা অবধি নাকি সেই মানুষটার সঙ্গে গল্প করেছেন "
Masterpiece.
ReplyDeleteDaroon Daroon Budha Da..
ReplyDelete- Soumen