প্রথম বিয়ে : নব্বই এর দশক। আমার এক কাকার বিয়েতে কলকাতার বাইরে এক মফস্বলে গিয়েছি । সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, নিজেকে বেশ বড়ো মনে করি তখন। তাছাড়া মাবাবা ও কেউ সঙ্গে যায়নি। 'বেশি পাকামি কোরোনা' জাতীয় কথা বলার কেউ নেই। তাই সুযোগ পেলেই যেকোনো কাজের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করছি। অবশেষে বিয়ের দিন সকালে একটা গুরুতর কাজের দায়িত্ত্ব পেলাম। পাত্রীর বাড়ি তে গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ত্ব ।
বিয়ের দিন সকালেই আমার বড় কাকা অসুস্থ হয়ে পড়েন, ওনার ওপরেই দায়িত্ত্ব ছিল তত্ব পার্টি কে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার । ওনার অসুস্থতার কারণে আমিই তখন একমাত্র অবশিষ্ট । আমার একটু কৌতূহল হলো " আচ্ছা এই বিয়েতে আমি কি একা বরযাত্রী?"
যেই কাকার বিয়ে তিনি বোঝালেন "না রে, আমার তিন জন মামা ও তাদের পরিবার ও আসবেন, আর খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী ও ট্রেন এ করে আসছে"
আমি একটু অবাক হলাম "সেই তিন মামারা কেউ তত্ব নিয়ে যাবেন না ?"
কাকার উত্তর " আজকে তো বুধবার, ওদের অফিস আছে, ওদের ছেলে মেয়েদের স্কুল আছে, তাই ওরা সন্ধ্যে বেলায় আসবে বলেছ। দাদার যে শরীর খারাপ হয়ে যাবে , সেকথা ওরা কি করে জানবে বল?"
জিগেশ করলাম " আর তোমার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী?"
কাকা উদাস ভাবে বললেন " ট্রেন লেট্ আছে খবর পেলাম, সকাল আটটায় আসার কথা ছিল, শুনছি বিকেল চারটেয় ঢুকবে। "
তারপরে একটু উৎসাহ নিয়েই বললেন "তুই তো এখন বড়ো হয়েছিস, তোকে আরো একটা কাজ দেব । তুই বিকেল এর দিকে স্টেশন এ চলে যাস , যদি শুনিস যে ট্রেন আরো লেট হবে তাহলে আমার শ্বশুরমশাইকে বলিস যে বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে । আমি তুই আর বাবা বরের গাড়িতে চলে যাবো। "
আমি একটু অবাক হলাম "তোমার তিন মামা কি করে যাবেন?"
কাকা এক গাল হাসলেন "ওরা তো আমার শ্বশুরবাড়ির দুটো গলি পেরিয়ে থাকে , ওদের ফোন করে দিবি , ওরা হেঁটেই চলে যাবে "
কাজের দায়িত্ত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে । আমি তাও জিগেশ করলাম " তোমার মামারা আমায় চিনবেন?"
কাকা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, " নিশ্চই চিনবে , আমার পৈতের অনুষ্ঠানে তোকে দেখেছিলো , তুই তখন সবে হাঁটা শুরু করেছিস , কত্ত খেলা করেছিল তোর সঙ্গে "
এরপরে আর নিশ্চিন্ত না হয়ে থাকা যায়না। কিন্তু শেষ প্রশ্ন টা তাও করেই ফেললাম "হঠাৎ করে যদি বলি বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে তোমার শ্বশুরমশাই আমার কথা শুনবেন? "
কাকা আস্বস্ত করলেন "নিশ্চই শুনবেন, তাই তো তোকেই পাঠাচ্ছি তত্ব নিয়ে। একবার তত্ব নিয়ে গেলে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই তোকে চিনে যাবে, সবাই জানবে তোর ওপর আমাদের সবার এতো ভরসা আছে । তুই যা বলবি সবাই সেটাকে গুরুত্ত্ব দেবে। তাই তো বলছি আর দেরি না করে বেরিয়ে পর,আর আমার শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমিয়ে ফিরবি "
এরপরে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তাই অবশেষে আমি এই গুরু দায়িত্ত্ব গ্রহণ করলাম। ছোটবেলায় বিয়েবাড়ি বলতে খাওয়া দাওয়াই বুঝতাম, অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতাম না । কোনো এক বিয়েবাড়িতে তো পাত্র পাত্রীর সঙ্গে দেখাও করিনি, সোজা খেতে বসে গিয়েছিলাম । এই প্রথম তত্ব জিনিষটা জানলাম। এখনকার বাঙালি পাঠক পাঠিকাগন সবাই নিশ্চই জানেন তত্ব ব্যাপারটা। তাই সেটা নিয়ে বিশেষ বর্ণনা করার চেষ্টা করছি না । কিন্তু তখনকার দিনে এতো আড়ম্বর ছিলনা । সুসজ্জিত গাড়ি নয়, সাধারণ সাইকেল রিক্সা করে আমি যাত্রা শুরু করলাম। দু হাত এ দই আর মিষ্টির হাঁড়ি, পায়ের নিচে জোড়া ইলিশ, আর কোলে শাড়ীর বাক্স নিয়ে আমি চলেছি । রিক্সাওয়ালা কে সারা রাস্তা ধরে অনুরোধ করে গেলাম আস্তে চালানোর জন্য, নইলে হাত থেকে হাঁড়ি পিছলে যাবে। রিকশাওয়ালা ও ক্রমাগত বলে গেলো “দাদা আরেকটু জোরে চালাতে দিন, নইলে স্কুল ছুটির সব প্যাসেঞ্জের হাতছাড়া হয়ে যাবে”।
অবশেষে হবু কাকিমার বাড়ি পৌছালাম। মিষ্টি শাড়ি ইত্যাদি হাত বদল হলো, সৌজন্য বিনিময় , চা শরবত সহযোগে পরিচয়পর্বের মাঝে খবর পেলাম রিক্সাওয়ালা আবার ফিরে এসেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দিলাম, আন্দাজ করলাম যে ওকে টাকা দেয়া হয়নি।
রিক্সাওয়ালা এক গাল হেসে বললো, “ দাদা জোড়া ইলিশটা তো রিকশাতেই রয়ে গেলো, কেউ তো নামালেন না, তাই আবার দিতে এলাম, এই আঁশটে গন্ধ নিয়ে কি আর স্কুল এর প্যাসেঞ্জের পাবো” ! কলকাতার রিক্সায় একবার একটা টুপি ফেলে এসেছিলাম, সেটা আর ফেরত পাইনি। তাই মফস্বলের এই সরল কিন্তু সৎ রিক্সাওয়ালার কথা আলাদা ভাবে মনে রয়ে গেছে |
দ্বিতীয় বিয়ে : পরের ঘটনাটি আমার এক মাসতুতো দাদার বিয়ে । ততদিন এ দশক , শতাব্দী সব বদলে গেছে । বাঙালিদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রাও কিছুটা বদলে গেছে| বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো একটু আড়ম্বর করে না করলে বাকিরা নিন্দা করেন ।তাই সব অনুষ্ঠান এখন আর পঞ্জিকার তিথি দেখে হয়না, নামকরা ক্যাটারের আর ভালো বিয়েবাড়ি কখন পাওয়া যায় সেই অনুযায়ী হয়। আমার এই দাদাটি (এবং হবু বৌদি) আমেরিকায় থাকে, ওর ছুটির সুবিধে এবং কলকাতার সেরা বিয়েবাড়ি পাওয়ার সুবিধে দুটো মিলিয়ে মিশিয়ে পৌষমাসে বিয়ে ঠিক হলো।
ততদিনে আমি তত্ব নেয়ার ব্যাপারে পারদর্শী হয়ে গেছি। আমি ঘোষণা করলাম " আমি তত্ব নেয়ার ব্যাপারে এখন এক্সপার্ট । কবে নিতে হবে, কোথায় নিতে হবে বোলো।"
মাসিমা বুঝিয়ে বললেন "ঐসব চিন্তা নেই, সব কিছু outsourced "
আমার হতভম্ব মুখ দেখে দাদা বোঝালো "আরে বুঝিস না, আমি আর তোর বৌদি, সবাই বিদেশ এ থাকি, আমাদের বন্ধুদের ভালো করে ফটো আর ভিডিও দেখাতে হবে তো। তাই এখন প্রফেশনাল আর্টিস্ট ভাড়া করেছি তত্ব সাজানোর জন্য । "
আমি একটু অবাক হলাম "তত্ব মানে তো কয়েকটা শাড়ি আর মিষ্টি, ওতে সাজানোর কি আছে?"
দাদা বোঝালো "ফটো তে যাতে ভালো দেখায়, তাই এখন অনেক ডেকোরেশন করতে হয়। মিনিমাম সংখ্যার জিনিষকে ম্যাক্সিমাম সংখ্যার ডালায় সাজানো, ঘরের লোকজন কি পারে ওই আর্টিস্ট লেভেল এর সাজাতে? "
আমি একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম "বৌদির বাড়ির তত্ব ও কি outsourced ?"
দাদা উৎসাহের সঙ্গে বললো "হ্যা রে, এক আর্টিস্ট করছে, যাতে ব্যাপারটা same লেভেল এর হয় । আর তাছাড়া ডিসকাউন্ট ও আছে "
আমি অবাক হয়ে গেলাম "তত্ব সাজানোর ও ডিসকাউন্ট ?"
দাদা বোঝালো "হ্যা রে, দুটো ফ্যামিলি একসঙ্গে কন্ট্রাক্ট দিলে কুড়ি% ছাড়, আমরা তো ঐজন্যই দুই বাড়ির কাজও এক পুরোহিত দিয়েই করাচ্ছি। ওখানেও ডিসকাউন্ট !"
আমি হাল ছেড়ে দিলাম "তাহলে আমায় কি করতে হবে?"
মাসিমা উৎসাহের সঙ্গে বললো "তুই বরং জুতো পাহারা দিস, বিয়েতে একটা নিয়ম আছে না জুতো লুকিয়ে রাখার ?"
আমি একটু চিন্তিত হয়েই বললাম " আমি কিন্তু কোনো বিয়েতে কারোর জুতো লুকিয়ে রাখার নিয়ম দেখিনি , যদিও এটা ঠিক যে খাওয়া দাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু আমি খেয়াল করতাম না আগে ।"
দাদা একগাল হেসে বললো "কি যে বলিস, বলিউড এর সিনেমায় দেখিস নি?"
আমি প্রতিবাদ করলাম "সেটা তো সিনেমা!"
দাদা বললো "আরে তুই বুঝিস না, আমেরিকায় গিয়ে যখন সবাইকে বিয়ের ছবি, ভিডিও ইত্যাদি দেখাবো, ওরা তো সিনেমায় যা দেখে তারসঙ্গে মিলিয়ে দেখবে যে BIG INDIAN WEDDING হয়েছে কিনা। তোর বৌদি কিন্তু আগেই বলে রেখেছে, একটুও খুঁত থাকলে চলবে না , একদম বলিউড স্টাইল এর BIG INDIAN WEDDING চাই "
আমি বুঝলাম যে এটাই এখনকার নীতি , মানিয়ে নেওয়া ভালো। সিনেমাতে জুতো লুকোনোর পরে যে টাকা দেয়া দেখায় সেটাও হবে কিনা জানতে চাইলাম । মাসিমা খুব উত্তেজিত হয়ে ফোনের দিকে ছুটে গেলেন বৌদির বাড়িতে ফোন করতে ।
"আচ্ছা জুতো র ব্যাপারটা হচ্ছে তো?"
" জুতো? মানে জামাইকে নতুন জুতো দিচ্ছি কিনা জানতে চাইছেন? ওটা মনে হয় তত্ব র সঙ্গে যাবে। বিয়ের মণ্ডপে চাই নাকি?"
"আরে না না, আমি জুতো লুকোনোর কথা বলছিলাম "
"ও আচ্ছা, হ্যা মানে আমি ঠিক জানি না , কেন বলুন তো?"
" আসলে কতজন ভাইবোন মিলে লুকোবে সেটা জানা থাকলে সেইমতো একটা হিসেবে, মানে সেইমতো একটু ক্যাশ, মানে বুঝেছেন তো? মানে আজকাল যেরকম দেখায় টিভি তে "
"ওহ আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি । দাঁড়ান, একটু পরেই জানাচ্ছি "
আধঘন্টার মধ্যেই বৌদির বাড়ি থেকে খবর এলো যে মামাতো মাসতুতো খুড়তুতো পিসতুতো বাহিনী মিলিয়ে ওরা মোট পঁচিশ ভাই বোন। মিনিট দশেক পরে খবর এলো যে বৌদির কিছু বান্ধবীও যোগদান করবেন এই জুতো চুরির মহান কর্মযজ্ঞে , তাই মোটামুটি পঁয়ত্রিশ জনের হিসেবে করে আসাই ভাল। মাসিমা কাগজ পেন নিয়ে হিসেবে করে দাদাকে বললো যে মাথাপিছু দুশো ধরে নিয়ে সাত হাজার ক্যাশ রেডি করে আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে। সাত হাজার ডলার শুনে দাদা আর্তনাদ করে উঠেছিল, কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই সামলে উঠলো যখন মাসিমা বোঝালেন ওটা সাত হাজার টাকা, সাত হাজার ডলার নয় । সেই মতো আমরা সন্ধ্যাবেলায় রওনা হলাম।
আমি ভাই হিসেবে খুবই কর্তব্যপরায়ণ। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে সারা সন্ধ্যে জুতো পাহারা দিয়েছিলাম । এতই নিষ্ঠার সঙ্গে পাহারা দিয়েছিলাম, যে বিয়েতে কন্যা সম্প্রদানের পরেই বৌদির বাবার গর্জন শোনা গেলো "আমার চটি কে লুকিয়ে রাখলি রে ? আজ অবধি কোনো বিয়েতে মেয়ের বাবার জুতো লুকোনো দেখিনি, সিনেমাতেও না ! "
কি আর করা, আমি তো দায়িত্ত্ব নিয়ে দাদার চটি সামলে রেখেছিলাম , বাকিরা তাই ভুল করে দাদার শ্বশুরমশাইয়ের চটিজোড়া হাতিয়ে নিয়ে গেছে । ওদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায়না, আসলে দুই জোড়া চটি তো এক দোকান থেকে একসঙ্গেই কেনা, ওখানেও তো ডিসকাউন্ট !!
তৃতীয় বিয়ে : আরো একটি দশক পেরিয়ে গেছে। বাঙালিদের বিয়ে এখন পুরোদস্তুর BIG INDIAN WEDDING স্টাইল এর সাড়ম্বর বিয়ে। এক দশক আগেই তো কুষ্ঠি – ঠাকুরমশাই - পঞ্জিকা ছেড়ে ক্যাটারের - ডেকোরেটর এর মর্জিমতো বিয়ের দিন ঠিক হতো । এই দশক এ দেখা গেলো অনুষ্ঠানের প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া হয় ফটোগ্রাফার এর মর্জি মতো। ফটো ঠিকমতো ফোকাস না হলে ৩ বারের জায়গায় ৫-৬ বার ও মালা বদল করতে হয়। আগুন এর ঔজ্জ্বল্যর সঙ্গে বৌয়ের বেনারসির ঔজ্জ্বল্য যতক্ষণ না মিলছে, ততক্ষন অবধি বর বৌ আগুনের ধারে পাক খেয়েই যায়, অনেকসময় সাত এর বেশি। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে আবার ক্যাটারের , ডেকোরেটর ইত্যাদিকে দেখাশোনা করার জন্য ইভেন্ট ম্যানেজার থাকেন, বাড়ির কোনো আত্মীয়কে সেই দায়িত্ব নিতে হয়না, ওনারা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে সেলফি তুলতে থাকেন।
পরের ঘটনা সেইরকম যুগের একটি বিয়ের । আমেরিকা থেকে ছুটিতে দেশে এসেছি, সেইসময়ে এক বান্ধবীর বিয়ে । বিয়েবাড়িতে সিঁড়ির মুখে একটা হোঁচট খেয়ে পুরো একটা দরজার ফুল, মালা ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলেছি। বেশি কেউ দেখার আগেই ব্যাপারটা সামলে ফেলতে হবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি ডেকোরেটর কে ডেকে আনলাম। ঠিক এই সময়েই বরযাত্রীরা দলবল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, হঠাৎ পেছন থেকে ক্রূদ্ধ তরুণী কণ্ঠ ভেসে এলো "আপনার কি কোনো আক্কেল নেই, দেখছেন যে বর বেচারি অনেক কষ্টে ধুতি সামলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, আর সেখানে আপনি রাস্তা আটকে কি করছেন?"
নিজের ভুলটা যথা সম্ভব চেপে রাখাই ভালো। তাই আমি একটু আমতা আমতা করেই বললাম "ওই একটু ফুলগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছি"
তরুণী আবার গর্জে উঠলেন "আচ্ছা বলুন তো, বিয়েতে কোনটা বেশি দরকার, ফুল দিয়ে সাজানো গেট নাকি বর?"
আমি ওনাদের কে বরযাত্রীদের ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে নিরীহ ভাবেই বললাম "আমরা তো জানি যে বর বেশি দরকারি, কিন্তু আজকালের বর- বৌরা আবার সাজসজ্জার দিকেও খুবই গুরুত্ত্ব দেন, নইলে ছবি ভালো আসে না"
তরুণী দেখলাম একটু শান্ত হলেন "হ্যা এটা একদম ঠিক কথাই বলেছেন, ভালো করে সাজান না যত পারেন, আমি খালি ভয় পাচ্ছিলাম ঐটুকু জায়গা দিয়ে বর যেতে পারবে কিনা"
আমি তরুণীকে ভরসা যোগালাম "আমি তো জানতাম যে এই বিয়ের পাত্র নাকি অসাধ্য সাধন করতে পারেন । আর আপনি ভাবছেন এই জায়গা দিতে যাতে পারবেন না ।"
তরুণী ভ্রূকুটি করলেন "মানে, কি বলতে চাইছেন?"
আমি মোক্ষম দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরলাম "আজকাল ভালো ক্যাটারের এর জন্য ৫-৬ মাস আগে বলতে হয়, ভালো বিয়ে বাড়ি পেতে গেলে এক দেড় বছর আগে নাম লেখাতে হয়, আর ভালো পাত্রী পাওয়া তো বহু বছরের সাধনার কাজ । কিন্তু শুনেছি উনি নাকি এই সমস্ত কঠিন কাজ এক বছরের মধ্যেই করে ফেলেছেন, তাই বলছিলাম "
দেখলাম কথাটা তরুণীর মনে ধরেছে । "ভালোই তো ডায়ালগবাজি পারেন দেখছি" বলে মুচকি হেসে চলে গেলেন। মনে হলো যে উনি নিশ্চই ঠান্ডা হয়েছেন এতক্ষনে, তবুও সাবধানের মার্ নেই ।আমি তাই ওনাকে ঠান্ডা রাখার জন্য আরো দুটো এক্সট্রা আইস- ক্রিম ও দিয়ে এলাম , বিয়েরদিনে বরযাত্রীকে চটিয়ে কাজ নেই।
পরের কিছু ঘন্টা নির্বিঘ্নেই কাটলো। বিপত্তি ঘটলো বাসর ঘরে । আমাকে দেখে সেই তরুণী চমকে গেলেন "আপনি বাসরঘরে কি করছেন? আপনার কাজ তো হয়ে গেছে নাকি?"
আমিও একটু ঘাবড়ে গেলাম, আমার কাছে যেটা সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ, অর্থাৎ ভুরিভোজ, সেটা তো এখুনি শেষ করেই এসেছি । তরুণী কি করে সেটা বুঝে গেলেন? আমি একটু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম যে "বাসর ঘরে একটু গল্প গুজব করতে এলাম সবার সঙ্গে, এই আর কি"
তরুণী ও মুচকি হেসে বললেন "আপনি তো খুবই কর্তব্যপরায়ণ ইভেন্ট ম্যানেজার দেখছি, আজ অবধি কোনো ইভেন্ট ম্যানেজার কে বাসরঘর সামলাতে দেখিনি"
আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে জানালাম যে আমার কোনো কিছু ম্যানেজ বা সামলানোর ক্ষমতা খুবই সীমিত , আমি তাই পাত্রীর বন্ধু হিসেবেই এসেছি ।
তরুণী দেখি চমকে গেলেন, "তাহলে স্যুট পড়েন নি কেন?"
সত্যি কথা বলতে আমার আমেরিকা থেকে কলকাতায় ফিরলে সবসময় গরম লাগতো, তাই জিন্স টিশার্ট পরেই এসেছিলাম বিয়েতে , স্বীকার করে ফেললাম "খুবই ভুল হয়ে গেছে জানি স্যুট না পড়াটা, আসলে স্যুট পড়লে তো খুব গরম লাগে , তাই "
তরুণীও একটু লজ্জিত হয়েই স্বীকার করলেন যে আমাকে ইভেন্ট ম্যানেজার ভেবে উনি এতক্ষন কথা বলেছিলেন, কিন্তু সঙ্গে এটাও জানাতে ভুললেন না যে আমার পোশাক আশাকের জন্যই এই বিপত্তি। "ইভেন্ট ম্যানেজার সেজে ডায়ালগবাজি ছাড়া কি করা হয়" উনি জানতে চাইলেন। আমি সত্যিটাই বললাম "ছোট একটা গ্রাম এর ব্যাঙ্ক এ কাজ করি"
তরুণী একটু ক্ষুন্ন স্বরে প্রশ্ন করলেন "মানে আপনি কি টাকা গোনার কাজ করেন?"
আমিও মেনে নিলাম "হ্যা, অনেকটা ঐধরণের কাজই করি"
তরুণী আমায় আস্বস্ত করলেন যে নিষ্ঠার সঙ্গে করলে সব কাজই সমান ভালো । আমিও এককথায় এই সত্যটি স্বীকার করে নিয়েছিলাম।
এই ঘটনার মাসখানেক পরে সেই তরুণী ফেইসবুক থেকে আমায় খুঁজে বের করে আবার প্রচুর ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন । আমি যে আমেরিকায় থাকি, পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, এইসব না বলে ওনাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলায় উনি যে অত্যন্ত রাগ করেছেন সেটা জানাতেও ভুললেন না । আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওনাকে বোঝানোর, গ্রাম জিনিষটা যে শুধু ভারতেই থাকে, আমেরিকায় থাকে না, এই ধারণা নিয়ে উনি যদি ভুল বোঝেন তো আমি কি করব। আমি তো সত্যি আমেরিকার একটা গ্রামেই চাকরি করি।
তরুণী আরো অভিযোগ করলেন -আমার পেশা নিয়ে মিথ্যে বলা উচিত হয়নি, ওনার এতে খুবই অভিমান হয়েছে । আমি অবশ্য বারবার ওনাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম যে সত্যি আমার কাজ টাকা গোনা, ব্যাঙ্কের কোন ব্রাঞ্চ এ কত টাকার লেনদেন হচ্ছে, কোন ক্রেডিট কার্ডে কত টাকার কেনাবেচা হচ্ছে, এইসব হিসেব করার সফটওয়্যার প্রোগ্রাম বানাই। উনি যদি ভাবেন ব্যাঙ্ক কর্মচারী মানেই ক্লার্ক, তাহলে আমি কি করবো? ব্যাংকে ক্লার্ক থেকে শুরু করে ম্যানেজার, প্রেসিডেন্ট , সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সবাই কাজ করে একথাও বলেছিলাম । তাও ওনার অভিমান কমেনি ।
উপসংহার : এই তিন দশক ধরে দেখলাম, কেউ ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে বাঙালি সেজে বিয়ে করে, কেউ আবার স্যুট পড়ে সাহেব সেজে বিয়ে করে। কখনো তত্ব সাইকেল রিক্সায় যায়, কখনো আবার তত্ব outsource হয়ে যায়। যুগের ধর্মই পরিবর্তন , আগামী দশকে হয়তো আরো পরিবর্তন আসবে । হয়তো এরপরে বিয়ে অনলাইন হবে, হয়তো শুভদৃষ্টি facetime এ হবে, হয়তো অতিথিরা জুম্ মিটিং এ নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করবে। যে তিনটি বিয়ের কথা বললাম, সেই তিন জোড়া দম্পতি আজও সুখে শান্তিতে সংসার করছে। সুতরাং আশা করা যায় যে আগামী দিনের দম্পতিরাও সুখেই থাকবেন, সে বিবাহ অনুষ্ঠানের আড়ম্বর বাড়ুক বা কমুক যাই হোক না কেন ।