Wednesday, February 10, 2021

বিদেশে বাণী বন্দনা

 


প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় যারা কোনোদিন সরস্বতী  পুজোর প্যান্ডেল সাজায়নি, নববর্ষের প্রভাত ফেরি তে যায়নি, যারা দুর্গাপূজায় অঞ্জলি না দিয়ে শুধু মাত্র নতুন জামা পরে ফ্যাশন করেছে , তারাও আমেরিকায়  এসে বিশাল সংস্কৃতি মনস্ক হয়ে যায় । 

আমিও এইরকম এক বাঙালি । কুড়ি পঁচিশটা বাঙালি পরিবার মিলিয়ে সরস্বতী পুজো করবো ঠিক করেছি। তাই এক শনিবার সকালে আমার সহকারী তপন কে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম  আদিত্য রায় এর বাড়ি । আদিত্য দা আমাদের পরিচিত মহলের সবচেয়ে সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ, যাকে কেউ কেউ সবচেয়ে আঁতেলও বলে থাকে।  

আদিত্যদা আমাদের পুজোর পরিকল্পনা শুনে  প্রথমেই বাউন্সার ঠুকে দিলেন
"আমেরিকার বাঙালিদের সরস্বতী পুজো করার উদ্দেশ্য কি বল"

আমি তৈরী হয়েই এসেছিলাম, বললাম যে দোলযাত্রা, স্বাধীনতা দিবস বা দীপাবলি ও তো বাকিরা করে, তাহলে সরস্বতী পুজোর বাদ যায় কেন ?
 
আদিত্য দা বক্তব্য শুরু করলেন "প্রথম কথা এটা আঞ্চলিক প্রথা, যা কিনা দোলযাত্রা, স্বাধীনতা দিবস বা দীপাবলির মতো  সারা ভারতে অনুষ্ঠিত হয়না । এটা শুধুমাত্র বাঙালিদের অনুষ্ঠান ।  তাছাড়া এখানে তো আর স্কুল কলেজে সরস্বতী পুজো হয়না, যে ছোটরা দায়িত্ত্ব নিয়ে একটা পুজোর আয়োজন করবে । তাহলে আমরা, এই মাঝবয়েসী সম্প্রদায় কেন বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে সরস্বতী পুজো করবো ?"

 তপন তড়িঘড়ি চেষ্টা শুরু করলো প্রসঙ্গ টা হালকা করার "দেখুন আদিত্য দা, জানেন তো  সরস্বতী পুজো হচ্ছে বাঙালিদের ভ্যালেন্টাইন্স ডে । তাই আমরা  সরস্বতী পুজো করে ছোট বেলার স্কুল জীবনের ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন এর স্মৃতি রোমন্থন করবো ।"

আদিত্য দা  কথাটা উড়িয়ে দিলেন  "ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করতে যেটা সবচেয়ে  বেশি প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রেম , সেটা বেশিরভাগ বাঙালির কপালেই জোটে না । অন্তত স্কুল জীবনে সরস্বতী পুজো করার বয়েসে জোটে না ।"

তপন চমকে গেলো " কি বলছেন? বাঙালিরা স্কুল কলেজ এ প্রেম করে না? আমাদের প্রেম জোটে না ?"

আদিত্যদা হাসলেন "ভেবে দেখ, যদি বেশিরভাগ বাঙালিদের প্রেম জুটতো তাহলে নীলাঞ্জনা, বেলা বোস কিংবা সুকান্ত জাতীয় বিরহের গান এতো  জনপ্রিয় হতো না । বাঙালিদের নিয়ে বলা হয় জন্ম থেকে সেন্টু খেয়ে শহীদ শহীদ ভঙ্গি, গুলির আগেই সারেন্ডার আর প্রেমের আগেই লেঙ্গি।  তাই বাঙালিদের বেশিরভাগ ক্রাশ গুলো প্রেমে পরিণত হওয়ার আগেই crushed হয়ে যায়।  ভ্যালেন্টাইন্স ডে অবধি গড়ায় না ব্যাপারটা । "

একটা লম্বা নিঃশাস নিয়ে বক্তব্য শেষ করলেন "বুঝলি তো, সরস্বতীপুজোর নাম করে আমরা ছোটবেলার ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করার স্মৃতি রোমন্থন করছি, এই যুক্তি টা দু -পাঁচ জনের জন্য হতে পারে, সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য হতে পারে না।"

এবারে আমি ম্যানেজ দেয়ার চেষ্টা করলাম "শুধু সরস্বতী পুজো কেন, আমরা বাঙালিরা যেকোনো পুজো বা যেকোনো অনুষ্ঠান  করি সেলফি তোলার জন্য । অনুষ্ঠান মানেই সেখানে প্রচুর সুন্দরীর সমাগম হবে, এবং তারপরে সেই সুন্দরীদের  সুন্দর সুন্দর সেলফি স্মার্ট ফোন এর মাধ্যমে ছড়িয়ে যাবে ফেইসবুক আর ইনস্টাগ্রামে , এবং ক্রমশ সেখান থেকে  ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শহর আর বিভিন্ন গ্রামে । ধরুন না আমরা সেলফি তোলার কিছু সুযোগ করে দিচ্ছি এই অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে, আর সেই সঙ্গে পুজো হচ্ছে, খিচুড়ি খাওয়াও হচ্ছে "

আদিত্য দা তবুও অনড় " আজকের যুগের ধর্ম যাই হোক না কেন ,মনে রাখতে হবে যে একটা সময় ছিল যখন ফেইসবুক ছিল না, স্মার্টফোন ছিল না, সেলফি ও ছিল না,  কিন্তু তখনও সরস্বতী পুজো হতো । তাই শুধুমাত্র লোক দেখানো ছবি তোলা নয়, সরস্বতী পুজোর এই কালজয়ী প্রথার পেছনে নিশ্চই আরো গভীর কোনো কারণ আছে । ভেবেছো কি সেই কারণ?  কেন আমরা  বাঙালিরা সরস্বতী পুজো করি ?"

তপন আবার আইডিয়া দিলো , "দেখুন আদিত্য দা ,  সরস্বতী পুজো হয় মাঘ মাসে , মাঘ মাসের পরেই আসে ফাল্গুন মাস আর সেই সঙ্গে আসে অ্যানুয়াল পরীক্ষা কিংবা বোর্ড  এর পরীক্ষা । মা সরস্বতী বিদ্যার দেবী । ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্ট হোক কিংবা লাস্ট, জীবন প্রেমপূর্ণ হোক বা প্রেমশূন্য , পরীক্ষার আগে মা সরস্বতীর আশীর্বাদ নিতে কেউ পিছপা হয় না । সেইজন্যই  তো ছোটবেলায় আমরাও  সবাই  'বিদ্যাং দেহি নমস্তুতে' বলে পুষ্পাঞ্জলি দিতে যেতাম ।"

বিদ্যার দেবী প্রসন্ন হয়েছিলেন বলেই আজকাল বিভিন্ন দেশে এতো প্রবাসী বাঙালি দেখা যায় । কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ হয়তো উচ্চপদস্থ চাকরির জন্যই বিদেশে আবির্ভূত হয়েছেন । আর দেবী সরস্বতীর অবদান ভুলতে পারেননি বলেই আজও দেবীর পুজো করেন । এই ব্যাখ্যা টা আদিত্য রায়ের মনঃপুত হবার কথা।  
কিন্তু আদিত্য দা তবুও আরেকটি বাঁকা প্রশ্ন করলেন "তার মানে কি বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতি শিক্ষিত হতে চায় না? অন্য কোনো জাতি কি পড়াশোনা করে না? তারা কেন এতো মেতে ওঠে না সরস্বতী পুজো নিয়ে?"

সত্যি এবার আর উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আদিত্য দা নিজেই বুঝিয়ে  দিলেন ।
ভারতের কিছু রাজ্য আছে, যেখানে লোকজন বলেন "ছেলেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে যাতে বিদেশে গিয়ে ডলার কামাতে পারে"
কিছু  লোকজন বলেন "মেয়েকে MBA  পড়াবো যাতে Mumbai তে ফ্লাট কিনতে পারে" ।
কেউ কেউ বলেন " আইএএস করতে হবে, তবেই ডজন খানেক লোক এর সেলাম পাওয়া যাবে" । যারা শিক্ষা বা বিদ্যা কে উপার্জনের মার্গ ভাবেন, তারা সরস্বতীপূজা না করে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনাই তো করবেন।

তপন উত্তেজিত হয়ে উঠলো, "এগুলো দার্শনিক কথাবার্তা। টাকা উপার্জন করা, কিংবা খ্যাতি উপার্জন করা কি ভুল?"

আদিত্য দা বললেন " কখনোই নয়। এইজন্যই আমরা বাঙালিরা ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো আর সরস্বতী পুজো, দুটোই করি। জীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতি যেরকম দরকার, সেইরকম সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তিও দরকার। কিন্তু এই দুটো দরকারকেই আলাদা করে গুরুত্ব দেয়া উচিত, একটা দিয়ে অন্যটাকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত না। "

আদিত্য দা র বক্তব্য টা বুঝলাম। হয়তো এইজন্যই বাঙালিরা শিক্ষালাভ কে অর্থ লাভ বা প্রতিপত্তিলাভ এর মার্গ ভাবেন না, শিক্ষা কে শুধুমাত্র শিক্ষার মতো করেই সম্মান জানান । অন্তত আমাদের ছোটবেলায় বাঙালি ঘরে ঘরে তাই হতো। সত্যি তো, সরস্বতী পুজোর দিন প্রার্থনা করার সময়ে আমরা কখনো বলিনি যে "মা, এমন বিদ্যা দাও মা, যাতে ডলার কমাতে পারি, এমন বিদ্যা দাও মা যে মুম্বাই এর মধ্যভাগে ফ্লাট কিনতে পারি" ।  

তখন বাঙালিদের ঘরে এক দেয়ালে পাশাপাশি ঠাঁই পেত রবিঠাকুর আর বিদ্যাসাগর  মশাই এর ছবি । আমরা ওনাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য কে গুরুত্ত্ব দিতাম না, শ্রদ্ধা জানাতাম ওনাদের শিক্ষা আর সংস্কৃতি কে  । যখন কোনো স্কুল এর হেডমাস্টার ফতুয়া লুঙ্গি আর চপ্পল পরে  বাজার করতে যেতেন, পাড়ার দোকানদার বা বাচ্ছারা তাঁকে প্রণাম জানাতো । আদিত্য দা র প্রশ্নের উত্তর টা পেয়ে গেলাম।

"আপনি জানতে চাইছিলেন না, যে কেন আমরা বিদেশে বসে সরস্বতী পুজো করবো? বাঙালিদের যে একটা প্রাচীন ঐতিহ্য - শিক্ষা বা সংস্কৃতির জন্য সম্মান - সেই ঐতিহ্যটা টিকিয়ে রাখার জন্যই আমরা সরস্বতী পুজো করবো।"

আদিত্য দা খুশি হলেন "শাবাশ ! যতদিন বাঙালিদের মনে শিক্ষা বা সংস্কৃতির জন্য এই সম্মানটা থাকবে, ততদিন বাঙালিরা সরস্বতীপুজো চালিয়ে যাবে, সে প্রবাসী বাঙালি হোক বা বঙ্গবাসী । "
 তারপরে মুচকি হেসে বললেন "ভুললে চলবে না,  একজন বাঙালি বলেছেন যে টাকাপয়সা এমন একটা জিনিস, শিক্ষিত মানুষের হাতে পড়লে তার নাম 'অর্থ' , আর অশিক্ষিতের হাতে পড়লেই অনর্থ! "

Sunday, January 24, 2021

প্রগতি

 


প্রথম দৃশ্য 

************

১: এই নে (গ্লাস বা কাপ)  

 ২: ও হা দাও 

১:  এতদিনে এলি তুই 

২: পুজো তো আগামীকাল, নাকি?

১: হ্যা, ভাবছিলাম তুই দু একদিন আগে এলে জিনিস পত্র জোগাড় যন্ত্র করতে সাহায্য করবি , সে যাক যে , কালকে সকাল এ ফুল আর মিষ্টি টা কিনে আনিস 

২:  হা, নিশ্চই।  আচ্ছা কি পুজো করছো যেন ? সত্যনারায়ণ নাকি মা সন্তোষী 

১: সেকি রে, তোর মনে নেই, তোর জামাইবাবু শহীদ হয়েছিলেন এই দিন এ, প্রতি বছর এই দিনে পুজো করি 

 ২: হ্যা হ্যা মনে আছে তো, মানে occasion টা জানতাম, কি পুজো সেটা ভুলে গেছিলাম 

১:   জামাইবাবু কত স্নেহ করতেন তোকে, তোকে সঙ্গে করে নিয়ে কলেজ এ ভর্তি করিয়েছিলেন, তুই সব ভুলে গেছিস না? রিসার্চ  ছাড়া কিছুই মনে থাকে না তোর।

২: না না , ভুলিনি কিছু ,  আসলে এই  রিসার্চ এর কাজ টা জামাইবাবুর ঘটনা র সঙ্গেই জড়িত 

১: কিরকম? 

২: জামাইবাবু র মতো কত সৈন্য দেশের বর্ডার রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দেয়, কত সৈন্য আমাদের প্রতিবেশী সৈন্যের গোলাগুলিতে আহত বা নিহত হয়, আমার রিসার্চ এর কাজ সেইসব সৈন্যদের বাঁচিয়ে দেবে 

১: বাহ্ , খুব অ্যাডভান্স কিছু ওষুধ বানাচ্ছিস নাকি, যেটা সঙ্গে সঙ্গে সাড়িয়ে তুলবে?

 ২: না , সেটা নয়। আমি একটা জিনিস বানাচ্ছি যেটা থাকলে আর এতো সৈন্য কে লড়তে হবে না, আমি একটা ভাইরাস বানাচ্ছি 

১: ভাইরাস গিয়ে লড়াই করবে?

২: হ্যা, এটা খুব সংক্রামক আর সেইরকম মারাত্ত্বক ভাইরাস , একই সঙ্গে জ্বর স্বাসকষ্ট পেটখারাপ গা হাত পা ব্যাথা, সবকিছু হবে এটা 

১: কি সাংঘাতিক 

২: শুধু তাই না, এই ভাইরাস টা এমন ভাবে বানিয়েছি এটা মরুভূমির মতো গরম, আবার কাশ্মীর এর মতো ঠান্ডা , সব ক্লাইমেট এ বেঁচে থাকবে । অসম এর মতো বৃষ্টি ভেজা বা রাজস্থান এর মতো শুকনো পরিবেশ এ বেঁচে থাকবে 

১: এরকম মারাত্মক জিনিস দিয়ে কি হবে 

 ২: ভাব একবার, আমাদের দেশ এর সমস্ত বর্ডার এ এরকম ভাইরাস ছড়িয়ে রাখা থাকবে , কোনো শত্রু বা আতঙ্কবাদী ঢুকতে গেলেই এই ভাইরাস এর কবল এ পড়বে, আর ঐরকম জায়গায় চিকিৎসাও হবে না, সব বেটা মরবে 

১: আর এই ভাইরাস ছড়াবে কে?

২: কেন? আমাদের সরকার।  আমি পরশু দিল্লি যাবো, এই ব্যাপারে প্রতিরক্ষা দপ্তরে মিটিং আছে 

১: সেকি তুই পরশুই চলে যাবি ? আমি ভাবলাম কটা দিন থেকে যাবি এবার 

২: ফিরে এসে নাহয় একসপ্তাহ থেকে যাবো , ঠিক আছে? তোমার একমাসের মতো সব বাজার ও করে দিয়ে যাবো , ঠিক আছে ?

১: থাকে, তোর এই একসপ্তাহের গল্প বহু বছর ধরে শুনে আসছি।  চল এখন ডিনার করে নিবি 


দ্বিতীয় দৃশ্য 

************

১: কিরে, তোর কালকে কখন ফ্লাইট 

 ২: এই তো দুপুরে 

১: তোর রিসার্চ এর কথা নিয়ে ভাবছিলাম , যেটা কালকে বলছিলিস 

২: হ্যা, ভালো লেগেছে তো আইডিয়া টা? এরপরে আর আমাদের সৈন্য রা বর্ডার এ প্রাণ দেবে না 

১: তোর মনে আছে জামাইবাবু কিভাবে শহীদ হয়েছিলেন ?

২: হ্যা, শুনেছিলাম তো উনি প্রায় চার ঘন্টা ধরে একটা আউটপোস্ট রক্ষা করছিলেন , প্রায় পঞ্চাশ জন জঙ্গির সঙ্গে লড়াই করেছিলেন , ঐজন্যই তো পরামবীর চক্র দেয়া হয়েছিল ওনার নাম এ  

১: দু মাস আগে কার্গিল যুদ্ধর কুড়ি বছর উপলক্ষে একটা স্মরণসভা হয়েছিল, সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম যে (থেমে যাওয়া ) 

 ২: কি জানতে পারলে ?

১: চার ঘন্টা ধরে ও ওই পোস্ট টা দখল করতে না পেরে শেষমেশ শত্রুপক্ষ থেকে ট্যাঙ্ক এর গোলাবর্ষণ করে , আর 

২: বুঝেছি, ঐভাবেই জামাইবাবু শহীদ হয়েছিলেন 

১: না, আর গোলাবর্ষণ এর পরে আর তোর  জামাইবাবু মৃতদেহ ভালোভাবে খুঁজেই পাওয়া যায়নি , এতো গোলাবাজি হয়েছিল 

২: তুমি দুঃখ করো না দিদি , আমার ভাইরাস এর প্রতিশোধ নেবে 

 এই ভাইরাস যদি বর্ডার এ ছড়িয়ে দেয়া হয়, সংক্রমণ এর ভয়ে শত্রুপক্ষের লোকজনের মৃতদেহ কেউ নিতে আসবে না , কোনো পাকিস্তানী জঙ্গিও তাদের মৃতদেহ সৎকার করতে পারবে না 

১: তাহলে এই ভাইরাস টা আটকে দে, এটা ছাড়িস না 

 ২: কেন? তুমি চাও না জামাইবাবুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেই ? জামাইবাবু একজন সম্মানীয় সৈনিক, একা পঞ্চাশজনের বেশি শত্রুকে উনি মেরে গিয়েছিলেন, আর তুমি এরকম দুর্বল কথা বলছো 

১: উনি আরো পঞ্চাশটা পরিবারকে আমার মতো শোকসন্তপ্ত করে গেছেন, এটা ভাবলে তো দুর্বল লাগবেই 

২: আমার ভাইরাস টা বর্ডার এ গেলে আর আমাদের সৈনিক রা এই ভাবে মরবে না, আর কারোর পরিবারকে এরকম তোমার মতো কষ্ট পেতে হবে না 

১: কে বলেছে, ওই পাকিস্তান বা অন্যান্য জঙ্গিদের পরিবার, তারা তো আমার মতোই কষ্ট পাবে 

২: কি মুশকিল, এটাই তো প্রগতির নিয়ম, যেই দেশ যত প্রগতিশীল, তারা ততো সহজে শত্রুবধে করবে, নিজেদের সৈন্য না হারিয়ে 

১: প্রগতি মানে কি তার মানে শুধুই ধ্বংস? শুধুই লোক মারা ?

 ২: যুদ্ধক্ষেত্রে আর কি প্রগতি দেখাবো ?

১: কেন? এমন কিছু আবিষ্কার করা যায়না বিজ্ঞান দিয়ে যাতে মানুষের খাদ্যভাব চলে যায়? যাতে সব দেশের অর্থনীতি ভালো হয়, সব দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় , তাহলে আর কোনো দেশ এর অন্য দেশ এর সঙ্গে যুদ্ধ করার দরকার হবে না 

২: সারা পৃথিবীর সাম্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা করা কি বিজ্ঞান দিয়ে সম্ভব দিদি ? ওটার জন্য অনেক বড়ো রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে হবে 

১: তাহলে এমন কোনো ভাইরাস বানা না , যেটা মানুষকে শান্তি আর ভালোবাসার অনুভূতি গুলো বাড়িয়ে দেবে? প্যারিস না এমন কিছু বানাতে ?

২: কি যে বলো না তুমি (হাসতে হাসতে কাশি ) , এতো দুর্বল চিন্তা ধারা নিয়ে প্রগতি হয় না, এগোনোর জন্য সবসময়ে কিছু ক্ষতি তো স্বীকার করতেই হয় (আরো কাশি )

১: আমি জানি, আমি দুর্বল নোই, প্রগতির জন্য আমি তৈরী ক্ষতি স্বীকার করতে 

 ২: যাক (কাশি ) ভালো, কিন্তু আমার কি হলো (আরো কাশি, হাঁপানি )

১: তোর চা এর কাপ এ আমি কিছু মিশিয়ে দিয়েছি রে, আর তুই দিল্লি পৌঁছাতে পারবি না 

২: ( !!!!! )

১: মানুষ এর জীবন এর সঠিক মূল্য বুঝতে পারাটাই আসল প্রগতি , এই প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো তোর এই ভাইরাস কে আটকানো দরকার রে , তাই জন্য আমি আমার একমাত্র আত্মীয় একমাত্র আপনজনের ও বলিদান করতে বাধ্য হলাম রে,  কিন্তু এটা আমাকে করতে হতো , তোর জামাইবাবুর জন্য, আর তোর জামাইবাবুর মতো আরো সমস্ত শহীদদের জন্য, সব মানবজাতির জন্য 


Tuesday, January 5, 2021

রাজবন্দী

 

প্রথম দৃশ্য :

১: কি হলো? এতো দেরি তোমার?

২: হ্যাপি আওয়ার এ গেছিলাম

১: আগে তো এইসব মোচ্ছব শুক্রবারে হতো , তোমরা আজকাল মঙ্গলবার থেকেই হ্যাপি আওয়ার করছো বুঝি ?

২: আসলে আমার প্রমোশন এর খবর টা আজকেই বেরোলো তো, সবাই তাই বললো যে আজকেই খাওয়াতে হবে  

১: বাহ্, খুব ভালো খবর তো

২: হুমম

১: কি ব্যাপার ? প্রমোশন হলো, কিন্তু খুশির রেশ নেই দেখছি

২: বহুবছরআগে জ্যোতিষীর কাছে গেছিলাম, তার ভবিষ্যৎবাণীর কথা ভাবছিলাম

১: যে বলেছিলো তিরিশ এর আগে গাড়ি হবে, পঁয়ত্রিশ এর আগে বাড়ি হবে , সেই জ্যোতিষী ?

২: হ্যা । মনে আছে আমার মৃত্যু নিয়ে কি বলেছিলো?

১: কি যেন বলেছিলো? রাজবন্দী হয়ে মৃত্যু হবে না কি একটা

২: (হেসে) not exactly , বলেছিলো বন্দিদশায় মৃত্যু হবে, আমার মৃত্যুর কারণ - রাজমুকুট 

১: যত্তসব গাঁজাখুরি কথা 

২: আরে বাকি সব তো মিলে গেছে, আমার পাঁচ নম্বর প্রমোশন এর বছরেই মৃত্যু হবে বলেছিলো, 

তাই চিন্তা করছি

১: চিন্তার কোনো কারণ নেই, এক যদি না তুমি ইংল্যান্ড এ গিয়ে রানী এলিজাবেথ এর মুকুট চুরি করার চেষ্টা করো, 

২: ধুরর

১: চিন্তা করতেই হয় তো একটা প্লাম্বার ডাকার ব্যাপারে চিন্তা করো, বা বাড়ির লোন তা refinance করবে কিনা চিন্তা কর।। 


দ্বিতীয় দৃশ্য :

 ১: এই তুমি টিকেট কেটেছ, ভাগ্নির বিয়ে তো পরের মাসে

২: এই সময় যাওয়া কি ঠিক হবে?

১: কেন ? এই সময়েতো ভালোই weather থাকে দেশে

২: আরে না, কলকাতায় আমাদের বাড়ি তো রানীকুঠি , সেখানে ওই এলাকায় যদি কোনো রাজা বা রানীর রাজমুকুট থেকে থাকে, সেই থেকে কেস খেয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তো আছে এই বছরে 

১: তাহলে রানীকুঠি যেতে হবে না, সোজা তোমার দিদির বাড়ি চলো এয়ারপোর্ট থেকে

২: এবাবা, ওদের বাড়ি তো মুর্শিদাবাদ , যদি নবাব সিরাজুদ্দোলার বা অন্য কোনো নবাব এর  রাজমুকুট ওই এলাকায় থাকে? জানো তো এই বছর টা একটু সাবধানে থাকতে বলেছে

১: তাহলে তুমি বিয়েতেই যাবে না?

২: ওটাই ভাবছি যে কি করি, অফিস এও এতো কাজ এখন

১: আমি কিন্তু যাবো, এমনিও অনেক নতুন শাড়ি জমে আছে, একবার ও পরা হয়নি, আর আমেরিকায় বসে বসে বহু বিয়েবাড়ি মিস করেচি।  আমার আর বাচ্চাদের টিকেট কেটে দিয়ো 


তৃতীয় দৃশ্য :

১: কি হলো বোলো তো? আজকে ইমেইল এসেছে যে ফ্লাইট ক্যানসেল 

২: হ্যা, ওই covid না করোনা কি যেন একটা অসুখ এসেছে, ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেছে, তাই সব ফ্লাইট বন্ধ

১: কি হবে এবার

২: চিন্তা করো না, কতদিন আর চলবে, বড়োজোর কয়েক সপ্তাহ

১: কিন্তু বাচাদের স্কুল? মেয়েটার তো সামনের বছর হাই স্কুল , এতগুলো কামাই হলে নাম কাটিয়ে দেবে

২: আচ্ছা দাড়াও, আমি স্কুল এ কথা বলে রাখছি


চতুর্থ দৃশ্য

১: কি খবর ? আজকে তো দেখলাম নিউ ইয়র্ক এ আরো চারশো জন মারা গেছে

২: হুম, আমাদের জার্সি সিটি ও পিছিয়ে নেই, এখানের বেশিরভাগ লোক তো নিউ ইয়র্ক এই চাকরি করতো

১: দেড় মাস হতে চললো, তুমি কি খাওয়া দাওয়া করছো আজকাল

২: কি আর, মুড়ি কিংবা আলুসেদ্ধভাত, অথবা খিচুড়ি

১: সেকি? খাবার পাওয়া যাচ্ছে না নাকি?

২: পরশু তো বললাম, এক তলার ব্যাচেলর গুলোর ফ্লাট এ করোনা হয়েছে, আজকে শুনলাম সামনের ফ্লাট এর গুজ্জু ভাই এর হয়েছে।  আমি এর মধ্যে আর বাড়ি থেকে বেরোনোর রিস্ক নিচ্ছি না

১: ঠিক আছে, সাবধানে থেকো , যা সব খবর দিচ্ছে, ভয় লাগে


শেষ দৃশ্য :

এখানে এখন বিকেল চারটে, জানি তোমাদের অনেক রাত । তাই ফোন না করে ভয়েস মেসেজ পাঠাচ্ছি।  দুদিন ধরে জ্বরটা খুব বেড়েছে, তোমাদের কথাও খুব মনে পড়ছে।  প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো তোমরা নেই, মেয়েটার জন্মদিনটাও হয়ে গেলো (কাশি ) 

সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে ওই জ্যোতিষীর কথা, সত্যি এখন করোনা র ভয়ে বন্দীদশাতেই রয়েছি দুমাস ধরে (আরো অনেক কাশি ) আর সবচেয়ে মজার কথা কি জানো? ব্রাউস করে দেখছিলাম (কাশি ) এই করোনা শব্দ টা এসেছে ক্রাউন থেকে , এই ভাইরাস টা নাকি রাজমুকুট এর মতো দেখতে ( কাশি কাশি )



Saturday, August 8, 2020

দূর্গা - অসুর সংবাদ

                      নারদ : এই অসুর, ওঠ না, আর কত ল্যাদ খাবি

অসুর: ও বাবা, তুই এসেছিস ? কি হলো আবার ?
নারদ : কি হলো আবার ? শরৎকাল, আশ্বিন মাস, এখন কি হয় সেটা ভুলে গেলি?
অসুর: না, কিছু ভুলিনি , বছর বছর ওই দশটা হাত আর গাদাকতক প্রিমিটিভ weapons আর একটা বুড়ো সিংহকে দিয়ে আমার মতো বীরপুরুষ কে কুপোকাত করার চক্রান্ত
নারদ : তাহলে এবার ওঠ, একটু গতর টা নাড়াচাড়া কর, জিম এ যা, বডি বানা, নইলে তো ফেসবুকে ভালো ফটো আসবে না 
অসুর:  এবছর যে করোনা মহামারী, চারদিকে LOCKDOWN আর QUARANTINE , এর মধ্যে পুজো হবে ?
নারদ : একি কথা, QUARANTINE বল আর করোনা বল , পুজো হবে না বললে বাঙালি ফেস্টিভ্যাল করবে কি করে ? 
অসুর: ধুত্তোর আমি যাবোনা , দুর্গার সঙ্গে মারপিট টা জুম্ মিটিং এ করা যাবে না? কলকাতা গেলেই তো দুসপ্তাহ QUARANTINE , ফিরে এসেও আবার QUARANTINE 
নারদ : জানি রে জানি । ঐজন্যই তো এইবছর মহালয়ার পাঁচ সপ্তাহ পরে পুজো , মাঝের সময়টা QUARANTINE 
অসুর : QUARANTINE তো দুসপ্তাহ হয় , এতদিন কেন? 
নারদ : পুজো শপিং করার জন্য, আগে তো সবাই ভিড় করে গুতোগুতি করে কেনাকাটা করতো , কিন্তু এখন তো সেসব হবে না।

                     অসুর :  কেন?

নারদ : সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ করতে হবে, অল্প অল্প লোক দোকানে ঢুকবে তাই বেশি সময় দেয়া 
অসুর :সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ ?
নারদ :  হ্যা রে , এটাই তো নিউ নরমাল 
অসুর: তাহলে এই নিউ নরমাল এর যুগে সোসিওপলিটিক্যাল stereotype ভেঙে আমাকে এবার জিততে দেয়া হোক
নারদ: ওবাবা, এইসব খটোমটো শব্দ কেন? একটু সাদা বাংলায় জলবৎ তরলং করে বল না
অসুর: উহু, আমি এইভাবেই বলবো। ইংরেজি ওয়ার্ডস আর phrases use না করলে আজকাল ভদ্র সমাজে পাত্তা পাওয়া যায় না । বাংলা কথা বলা লোকদের কেউ পাত্তা দেয়না ।
নারদ: একি কান্ড, তুই তো দেখছি বোকা বাক্সর পন্ডিত দের মতো কথা বলছিস , মধ্যবিত্ত বাঙালি অসুর, অসুর এর মতো থাকনা , ভদ্রলোক হওয়া দরকার কি তোদের মতন অসুরদের ?
অসুর: ভদ্র্লোকরাই তো আসল অসুর রে, যেইরকম দুর্নীতি আর মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে এই ভদ্রসমাজে , অসুররা নিজেদের identity হারিয়ে ফেলবে এরকম না হতে পারলে
নারদ: আচ্ছা ঠিক আছে, সেইসব কথা থাক। কি চাই তোর সেটা বল
অসুর: বলছি তো। আমি এইবারে হারবো না, আমায় ম্যাচফিক্সিং করে এবারে জিতিয়ে দে
নারদ : সেকি কথা, নারী শক্তির পরাজয়? আসুরিক শক্তির জয়? আমাদের হেরিটেজ এর কি হবে?
অসুর: হেরিটেজ বিলডিং ভেঙে তো ফ্ল্যাট আর মাল্টিপ্লেক্স তৈরী হচ্ছে, তোরা আবার হেরিটেজ নিয়ে কথা বলিস কি রে  
নারদ : আরে সেই হেরিটেজ নয়, আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলছি। ঐতিহ্য কি ভেঙে দেয়া যায় রে?
অসুর: এই বেশি বাতেলা মারিস না তো , তোরা বিদ্যাসাগর এর মূর্তি ভাঙতে পারিস, আর একটু ঐতিহ্য ভাঙতে পারবি না ? হ্যারে, তোরা পুজো করিস তো প্রাইজ পাবি বলে, তাই নিয়ে এতো ঢং করার কি আছে?
দূর্গা : এই অসুর, কি বক বক করছিস বল তো তখন থেকে ? আর এই নারদ, ওকে রেডি করিয়ে রাখিস নি কেন? 
নারদ : আরে আমি কখন থেকে try করছি, ও বলছে কিনা ম্যাচফিক্সিং করে ওকে জিতিয়ে দিতে হবে 
দূর্গা : এই যে মাথামোটা, ম্যাচফিক্সিং করবে ?
অসুর: হ্যা, করবো।
দূর্গা : ম্যাচফিক্সিং আজকাল বেআইনি /  যদি আমি রিপোর্ট করি তোর কিন্তু জেল হয়ে যাবে
অসুর: জেল এ যাওয়া তো গর্বের ব্যাপার। স্বদেশী আন্দোলন এর সময় থেকে আজ পর্যন্ত্য দেখসি, সমস্ত নাম করা নেতারাই তো জেল এ যায় 

                       নারদ : আগে  কিন্তু criminal দের সোশ্যাল মিডিয়া তে ট্রলিং হতো না।  টুইটার এ                              UNFOLLOW করার ভয় ও ছিল না , আজকাল কিন্তু এই সব হচ্ছে  

দূর্গা : সোশ্যাল মিডিয়া তে UNFOLLOW হয়ে গেলে  কিন্তু public sympathy পাবি না, স্পনসর ও পাবি না
অসুর: ও বাবা, তাহলে জেল চাই না 
দূর্গা : নে, রেডি হো, এবারে 
অসুর : এখন কেন রেডি হব? নারদ বললো যে  পুজো শুরু হতে ঢের দেরি আছে 
দূর্গা :  ব্যাকডেটেড মুখ্যু তুমি । প্রেস কনফারেন্স, মিডিয়া কাভারেজ , campaigning, এইসব শোনোনি ?
মেয়ে : এক মিনিট , এক মিনিট,  এইসব কি হচ্ছে?  প্রসেস আছে তো 
নারদ : আজ্ঞে আপনি কে দেবী?
মেয়ে: আমি জীবন বাংলা চ্যানেল থেকে এসেছি, দেবী আর অসুর এর বিগ ফাইট এর লাইভ টেলিকাস্ট করবে আমাদের চ্যানেল , এবং এই ফাইট টা নিবেদন করছে handloom  হ্যান্ডওয়াশ , surprise  সাবান,  চরম চানাচুর 
নারদ : আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, জীবন বাংলা ব্যাপার টা কি? আর দেবী অসুর এর লড়াই এর সঙ্গে সাবান আর চানাচুর র কি সম্পর্ক?
মেয়ে : কোথাকার ব্যাকডেটেড মানুষ হে আপনি? জীবন বাংলার নাম শোনেন নি? World er best  বাংলা চ্যানেল আমাদের জীবন বাংলা । বিজ্ঞাপন মানেই জীবন বাংলা , আমাদের চ্যানেল সেই number 1 চ্যানেল যেটা, এমা উঠে গেছে     
নারদ : যা , চ্যানেল উঠে গেছে ?
মেয়ে : আরে দূর, আমার নেইলপলিশ টা উঠে গেছে, খেয়াল করলাম এখুনি। 
নারদ : কি বিরক্তিকর ব্যাপার। আরে এই বিগ ফাইট এর মধ্যে আপনি বাগড়া দিচ্ছেন কেন?
মেয়ে: কিছু জানেন না আপনি, আজকাল যেকোনো বিগ ফাইট এর আগে টক্ শো হয় 
নারদ : টক ডাল জানি, কিন্তু টক্ শো? 
মেয়ে: সিনেমার আগে যেমন ট্রেইলার হয়, সেইরকম বড় ঝাড়পিট এর আগে আমার দুপক্ষ কে টিভি তে এনে ঝগড়া করাই, এতে TRP বাড়ে 
নারদ : ঝগড়া থেকে TRP ? আমি তো শুনেছিলাম যে বুদ্ধদেব গান্ধীজি র দেশ এ সবাই চায়  শান্তি আর ভালোবাসা 
মেয়ে : ঐসব বলার জায়গা শুধু পরীক্ষার খাতা আর ইতিহাস এর পাতা । রিয়েল লাইফ এ ঝগড়া ঝাটি কেচ্ছা কেলেঙ্কারি - এইসব নিয়ে PNPC  - এগুলো তো পাবলিক খায় 
নারদ : ও বাবা ঝগড়া লাগানোর কাজ যদি TV চ্যানেল করে তাহলে আমি এবারে কি করবো ? আমার ও তো দেখছি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস !!
মেয়ে : নিন, শুরু করুন। একদিকে দেবী () একদিকে অসুর (), আর এই যে মশাই আপনি কোন দিকে ?
নারদ : আমি আবার কোন দিকে ?
দূর্গা : এই নারদ, তুই কি অসুর নাকি ?
নারদ : এই  না না 
দূর্গা : তাহলে তুই আমার দিকে 
অসুর : ওই নারদ, পাল্টিবাজ কোথাকার, তুই মহিলা না পুরুষ ? কোন দলের ?
মেয়ে : Look, আপনারা ক্যান্ডিডেট কে প্রেসার দিচ্ছেন, ডিসকোয়ালিফাই করে দেব। হ্যা আপনি বলুন তো আপনি কোন টীম এর?
নারদ ; আমি ভাবছিলাম যে নিউট্রাল থাকি, নাকি ?
মেয়ে : সেরকম হয় নাকি?
নারদ: এই তো কয়েকদিন আগেই কলকাতায় একটা চরম দলাদলি হলো।  এক দল জিগেশ করলো তোরা বাঙালি না গুজরাটি কোন দলে ? একদল জিগেশ করলো যে তোরা ওই মহিলার দলে নাকি আমাদের পুরুষ সিংহের দলে? 
মেয়ে: তারপরে?
নারদ: তারপরে আবার কি, কলকাতার ওয়ার্ল্ড ফেমাস  কিছু লোক বললো আমরা নিউট্রাল । দলাদলি শেষ হয়ে গেলো, কিন্তু আজ অবধি কেউ বুঝতে পারেনি এরা কোন দলে
মেয়ে : তাহলে আপনি চিয়ারলিডার টীম এ 
নারদ: চিয়ারলিডার? সেটা কি?
মেয়ে: যারা নিউট্রাল,  তাদের জন্য একটা  গ্ল্যামারাস টীম বানিয়েছি আমরা। They are so neutral, যে  ব্যাটসম্যান ৬ মারলে ও dance করে , ব্যাটসম্যান আউট হলেও dance করে । ক্রিকেটার দের জল খাওয়া থেকে ফিল্মস্টার দের মদ খাওয়া, সব কিছুতেই এরা cheer up করে mental support বাড়ায় । আপনি যান, আমার crew আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবে 

                        নারদ: আচ্ছা আমি তাহলে cheer leader হয়ে যাই 

মেয়ে : যাই হোক, এবারে বিগ ফাইট এর টক্ শো । শুরু হোক। লেডিস ফার্স্ট 
দূর্গা : এই ফাইট এ আমি জিতবো, আমার জেতা উচিত। আমি রিপ্রেসেন্ট করি নারী শক্তি, আমি রিপ্রেসেন্ট করি নারী মুক্তি, আমি রিপ্রেসেন্ট করি ফেমিনিজম 
অসুর : নিকুচি করেছে তোর ফেমিনিজম এর । সবচেয়ে বড়ো ফেমিনিস্ট তো আমি। আমি বছর বছর এক মহিলার কাছে পড়ে পড়ে কেলানি খাই যাতে বাঙালি মহিলারা ফেস্টিভ্যাল স্পিরিট এ শপিং করতে পারেন, আর নিজেদের সুন্দরসুন্দর মুখগুলোর সেলফি আপলোড করতে পারেন 
মেয়ে : দারুন পয়েন্টস। রাউন্ড ১ অসুর 
দূর্গা : অত সহজ নাকি জেতা? হ্যারে অসুর, তোর পেছনে পার্টি ফান্ড বা ফিনান্সিয়াল ব্যাকিং আছে?
অসুর: না, আমার পেছনে মোষের ল্যাজ আছে 
দূর্গা: শুধু  ল্যাজে কি হবে? আমি ওয়াইল্ডলাইফ সাপোর্ট করি ।  সিংহ আছে । তোর কি ওয়াইল্ডলাইফ সাপোর্ট আছে?
অসুর : হ্যা, আছে তো। মাথায় উকুন আর পেট এ কৃমি আছে ।
দূর্গা : ইসঃ!
মেয়ে : রাউন্ড ২ দূর্গা 
অসুর: আমি জিতবোই । আমাকে জিততেই হবে। আমি রিপ্রেসেন্ট করি সাধারণ মানুষ কে। আমি বুদ্ধিজীবী নোই, আমি বোকা।মাথার বাইরে শিং আর ভেতরে গোবর। আমি সেই কমন ম্যান যে পড়ে পড়ে মার্ খায় যাতে ভদ্রসমাজ ফেস্টিভ্যাল করতে পারে । 
দূর্গা : পাবলিক সিম্প্যাথি নেয়া হচ্ছে? আমার সিচুয়েশন শুনবি? এই জীবন বাংলার সব কটা সিরিয়েল এর নায়িকাদের টোটাল যা ক্রাইসিস আমার নিজের ক্রাইসিস তার থেকে ও বেশি 
অসুর : কি ঢপ
দূর্গা : এই, তুই জানিস কিছু? আমার হাসব্যান্ড এমনিতে সেরা, কিন্তু লাইফস্টাইল সাধারণ বলে আমার বাবা এমন অপমান করেছে যে ও আর আমার বাপের বাড়ি যায়না কোনোদিন,

                       মেয়ে : Thats terrible.... 

দূর্গা : ছেলেটা র মুখেভাত দেবো, সেই অনুষ্ঠান এ এমন ক্রাইসিস পুরো মাথা ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি করতে হলো। 

                       নারদ : উফফ সে যা কান্ড  হয়েছিল, এখনো ভাবলে শিউরে উঠি  

দূর্গা :  নারীমুক্তি নারীশক্তি এইসব করার জন্য মেয়েদের অনেক পড়ালাম। বড়ো মেয়ে লেখাপড়া গান বাজনা, নাচ, আবৃত্তি, ছবি আঁকা , সব কিছুতেই তুখোড়, কিন্তু আজ অবধি পছন্দসই পাত্র 
পেলাম না। ছোট মেয়েটা বিয়ে করেছে , কিন্তু জামাই বাবাজীবন সবসময়ে শয়নে পদ্মনাভঞ্চ হয়ে শুয়ে থাকে , নয়তো এদিক ওদিক লীলাখেলা করে বেড়ায় 
অসুর : সত্যি নাকি? 
দূর্গা : তা নয়তো কি? এইসব চাপ দেখে আমার বর রোজ ওই শশান  এ বসে হ্যাপি আওয়ার করে। ওই আপদ নন্দী আর ভৃঙ্গী ও জুটেছে আস্কারা দেয়ার জন্য । 
অসুর: হ্যা রে দূর্গা, তোর এতো দুঃখ, তুই আমায় বিয়ে কর না?
দূর্গা : কি বলি? 
অসুর : দেখ, আমি রোজ রোজ হ্যাপি আওয়ার করবো না, গাঞ্জা ও খাবো না। প্লাস আমি অসুরদের রাজা, তোর বাপ্ পাহাড় দের রাজা, তাই অপমান ও করবে না ।একদম দারুন জুটি 
দূর্গা : আহা, শখ কত ব্যাটা মোষের। নে  মর (ত্রিশূল )
অসুর: আরে একি করলি রে। প্রপোস করেছিলাম, না বললেই পারতিস, ম্যাক্সিমাম একটা চড় মারতে পারতিস, ত্রিশূল মেরে দিলি? কে আছিস জয়োধ্বনি দে ।
নারদ :: সে আবার কি। loser  দের আবার জয়োধ্বনি হয় নাকি? cheer leader হয়েছি যখন লিডার দের cheer করবো, loser দের cheer করবো কেন ? বোলো দূর্গা মাই কি জয় । আসছে বছর আবার হবে 

Monday, August 3, 2020

তিনটি বিয়ের গপ্পো

প্রথম বিয়ে :  নব্বই এর দশক।  আমার এক কাকার বিয়েতে কলকাতার বাইরে এক মফস্বলে গিয়েছি । সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, নিজেকে বেশ বড়ো মনে করি তখন। তাছাড়া মাবাবা ও কেউ সঙ্গে যায়নি। 'বেশি পাকামি কোরোনা' জাতীয় কথা বলার কেউ নেই। তাই সুযোগ পেলেই যেকোনো কাজের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করছি। অবশেষে বিয়ের দিন সকালে একটা গুরুতর কাজের দায়িত্ত্ব পেলাম।  পাত্রীর বাড়ি তে গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ত্ব ।

বিয়ের দিন সকালেই আমার বড় কাকা  অসুস্থ হয়ে পড়েন, ওনার ওপরেই দায়িত্ত্ব ছিল তত্ব পার্টি কে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার । ওনার অসুস্থতার কারণে আমিই তখন একমাত্র অবশিষ্ট । আমার একটু কৌতূহল হলো " আচ্ছা এই বিয়েতে আমি কি একা বরযাত্রী?"

যেই কাকার বিয়ে তিনি বোঝালেন "না রে, আমার তিন জন মামা ও তাদের পরিবার ও আসবেন, আর খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী ও  ট্রেন এ করে আসছে"

আমি একটু অবাক হলাম "সেই তিন মামারা কেউ তত্ব নিয়ে যাবেন না ?"

কাকার উত্তর " আজকে তো বুধবার, ওদের অফিস আছে, ওদের ছেলে মেয়েদের স্কুল আছে, তাই ওরা সন্ধ্যে বেলায় আসবে বলেছ। দাদার যে শরীর খারাপ হয়ে যাবে , সেকথা ওরা কি করে জানবে বল?"

জিগেশ করলাম " আর তোমার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী?"

কাকা উদাস ভাবে বললেন " ট্রেন লেট্ আছে খবর পেলাম, সকাল আটটায় আসার কথা ছিল, শুনছি বিকেল চারটেয় ঢুকবে। "

তারপরে একটু উৎসাহ নিয়েই বললেন "তুই তো এখন বড়ো হয়েছিস, তোকে আরো একটা কাজ দেব । তুই বিকেল এর দিকে স্টেশন এ চলে যাস , যদি শুনিস যে ট্রেন আরো লেট হবে তাহলে আমার শ্বশুরমশাইকে বলিস যে বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে । আমি তুই আর বাবা বরের গাড়িতে চলে যাবো। "

আমি একটু অবাক হলাম "তোমার তিন মামা কি করে যাবেন?"

কাকা এক গাল হাসলেন "ওরা তো আমার শ্বশুরবাড়ির দুটো গলি পেরিয়ে থাকে , ওদের ফোন করে দিবি , ওরা হেঁটেই চলে যাবে "

কাজের দায়িত্ত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে । আমি তাও জিগেশ করলাম " তোমার মামারা আমায় চিনবেন?"

কাকা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, " নিশ্চই চিনবে , আমার পৈতের অনুষ্ঠানে তোকে দেখেছিলো , তুই তখন সবে হাঁটা  শুরু করেছিস , কত্ত খেলা করেছিল তোর সঙ্গে "

এরপরে আর নিশ্চিন্ত না হয়ে থাকা যায়না।  কিন্তু শেষ প্রশ্ন টা তাও করেই ফেললাম "হঠাৎ করে যদি বলি বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে তোমার শ্বশুরমশাই আমার কথা শুনবেন? "

 কাকা আস্বস্ত করলেন "নিশ্চই শুনবেন, তাই তো তোকেই পাঠাচ্ছি তত্ব নিয়ে।  একবার তত্ব নিয়ে গেলে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই তোকে চিনে যাবে, সবাই জানবে তোর ওপর আমাদের সবার এতো ভরসা আছে । তুই যা বলবি সবাই সেটাকে গুরুত্ত্ব দেবে।  তাই তো বলছি আর দেরি না করে বেরিয়ে পর,আর আমার শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমিয়ে ফিরবি "

এরপরে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।  তাই অবশেষে আমি এই গুরু দায়িত্ত্ব গ্রহণ করলাম।  ছোটবেলায় বিয়েবাড়ি বলতে খাওয়া দাওয়াই বুঝতাম, অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতাম না ।  কোনো এক বিয়েবাড়িতে তো পাত্র পাত্রীর সঙ্গে দেখাও করিনি, সোজা খেতে বসে গিয়েছিলাম ।  এই প্রথম তত্ব জিনিষটা জানলাম। এখনকার বাঙালি পাঠক পাঠিকাগন সবাই নিশ্চই জানেন তত্ব ব্যাপারটা।  তাই সেটা নিয়ে বিশেষ বর্ণনা করার চেষ্টা করছি না । কিন্তু তখনকার দিনে এতো আড়ম্বর ছিলনা । সুসজ্জিত গাড়ি নয়, সাধারণ  সাইকেল রিক্সা করে আমি যাত্রা শুরু করলাম। দু হাত এ দই আর মিষ্টির হাঁড়ি,  পায়ের নিচে জোড়া ইলিশ, আর কোলে শাড়ীর বাক্স নিয়ে আমি চলেছি । রিক্সাওয়ালা কে সারা রাস্তা ধরে অনুরোধ করে গেলাম আস্তে চালানোর জন্য, নইলে হাত থেকে হাঁড়ি পিছলে যাবে।  রিকশাওয়ালা ও ক্রমাগত বলে গেলো “দাদা আরেকটু জোরে চালাতে দিন, নইলে স্কুল ছুটির সব প্যাসেঞ্জের হাতছাড়া হয়ে যাবে”। 

অবশেষে হবু কাকিমার বাড়ি পৌছালাম। মিষ্টি শাড়ি ইত্যাদি হাত বদল হলো, সৌজন্য বিনিময় , চা শরবত সহযোগে পরিচয়পর্বের মাঝে খবর পেলাম রিক্সাওয়ালা আবার ফিরে এসেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দিলাম, আন্দাজ করলাম যে ওকে টাকা দেয়া হয়নি।

রিক্সাওয়ালা এক গাল হেসে বললো, “ দাদা জোড়া ইলিশটা তো রিকশাতেই রয়ে গেলো, কেউ তো নামালেন না, তাই আবার দিতে এলাম, এই আঁশটে গন্ধ নিয়ে কি আর স্কুল এর প্যাসেঞ্জের পাবো” ! কলকাতার রিক্সায় একবার একটা টুপি ফেলে এসেছিলাম, সেটা আর ফেরত পাইনি। তাই  মফস্বলের এই  সরল কিন্তু সৎ রিক্সাওয়ালার কথা আলাদা ভাবে মনে রয়ে গেছে | 

 

 

দ্বিতীয় বিয়ে : পরের ঘটনাটি আমার এক মাসতুতো দাদার বিয়ে  ততদিন  দশক , শতাব্দী সব বদলে গেছে   বাঙালিদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রাও কিছুটা বদলে গেছে|  বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো একটু আড়ম্বর করে না করলে বাকিরা নিন্দা করেন তাই সব অনুষ্ঠান এখন আর পঞ্জিকার তিথি দেখে হয়নানামকরা ক্যাটারের আর ভালো বিয়েবাড়ি কখন পাওয়া যায় সেই অনুযায়ী হয়। আমার এই দাদাটি (এবং হবু বৌদিআমেরিকায় থাকেওর ছুটির সুবিধে এবং কলকাতার সেরা বিয়েবাড়ি পাওয়ার সুবিধে দুটো মিলিয়ে মিশিয়ে পৌষমাসে বিয়ে ঠিক হলো।

ততদিনে আমি তত্ব নেয়ার ব্যাপারে পারদর্শী হয়ে গেছি। আমি ঘোষণা করলাম " আমি তত্ব নেয়ার ব্যাপারে এখন এক্সপার্ট  কবে নিতে হবেকোথায় নিতে হবে বোলো।"

মাসিমা বুঝিয়ে বললেন "ঐসব চিন্তা নেইসব কিছু outsourced  "

আমার হতভম্ব মুখ দেখে দাদা বোঝালো "আরে বুঝিস নাআমি আর তোর বৌদিসবাই বিদেশ  থাকিআমাদের বন্ধুদের ভালো করে ফটো আর ভিডিও দেখাতে হবে তো। তাই এখন প্রফেশনাল আর্টিস্ট ভাড়া করেছি তত্ব সাজানোর জন্য  "

আমি একটু অবাক হলাম "তত্ব মানে তো কয়েকটা শাড়ি আর মিষ্টিওতে সাজানোর কি আছে?"

দাদা বোঝালো "ফটো তে যাতে ভালো দেখায়তাই এখন অনেক ডেকোরেশন করতে হয়। মিনিমাম সংখ্যার জিনিষকে ম্যাক্সিমাম সংখ্যার ডালায় সাজানোঘরের লোকজন কি পারে ওই আর্টিস্ট লেভেল এর সাজাতে? "

আমি একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম "বৌদির বাড়ির তত্ব  কি outsourced ?"

দাদা উৎসাহের সঙ্গে বললো "হ্যা রেএক আর্টিস্ট করছেযাতে ব্যাপারটা same লেভেল এর হয়  আর তাছাড়া ডিসকাউন্ট  আছে "

আমি অবাক হয়ে গেলাম "তত্ব সাজানোর  ডিসকাউন্ট ?"

দাদা বোঝালো "হ্যা রেদুটো ফ্যামিলি একসঙ্গে কন্ট্রাক্ট দিলে কুড়িছাড়আমরা তো ঐজন্যই দুই বাড়ির কাজও এক পুরোহিত দিয়েই করাচ্ছি। ওখানেও ডিসকাউন্ট !"

আমি হাল ছেড়ে দিলাম "তাহলে আমায় কি করতে হবে?"

মাসিমা উৎসাহের সঙ্গে বললো "তুই বরং জুতো পাহারা দিসবিয়েতে একটা নিয়ম আছে না জুতো লুকিয়ে রাখার ?"

আমি একটু চিন্তিত হয়েই বললাম " আমি কিন্তু কোনো বিয়েতে কারোর জুতো লুকিয়ে রাখার নিয়ম দেখিনি , যদিও এটা ঠিক যে  খাওয়া দাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু আমি খেয়াল করতাম না আগে "

দাদা একগাল হেসে বললো "কি যে বলিসবলিউড এর সিনেমায় দেখিস নি?"

আমি প্রতিবাদ করলাম "সেটা তো সিনেমা!"

দাদা বললো "আরে তুই বুঝিস নাআমেরিকায় গিয়ে যখন সবাইকে বিয়ের ছবিভিডিও ইত্যাদি দেখাবোওরা তো সিনেমায় যা দেখে তারসঙ্গে মিলিয়ে দেখবে যে BIG INDIAN WEDDING হয়েছে কিনা। তোর বৌদি কিন্তু আগেই বলে রেখেছেএকটুও খুঁত থাকলে চলবে না , একদম বলিউড স্টাইল এর BIG INDIAN WEDDING চাই "

আমি বুঝলাম যে এটাই এখনকার নীতি , মানিয়ে নেওয়া ভালো। সিনেমাতে জুতো লুকোনোর পরে যে টাকা দেয়া দেখায়  সেটাও হবে কিনা জানতে চাইলাম  মাসিমা খুব উত্তেজিত হয়ে ফোনের দিকে ছুটে গেলেন বৌদির বাড়িতে ফোন করতে 

"আচ্ছা জুতো  ব্যাপারটা হচ্ছে তো?"

জুতোমানে জামাইকে নতুন জুতো দিচ্ছি কিনা জানতে চাইছেনওটা মনে হয় তত্ব  সঙ্গে যাবে। বিয়ের মণ্ডপে চাই নাকি?"

"আরে না নাআমি জুতো লুকোনোর কথা বলছিলাম "

" আচ্ছাহ্যা মানে আমি ঠিক জানি না , কেন বলুন তো?"

আসলে কতজন ভাইবোন মিলে লুকোবে সেটা জানা থাকলে সেইমতো একটা হিসেবেমানে সেইমতো একটু ক্যাশমানে বুঝেছেন তোমানে আজকাল যেরকম দেখায় টিভি তে "

"ওহ আচ্ছা আচ্ছাবুঝেছি  দাঁড়ানএকটু পরেই জানাচ্ছি "

আধঘন্টার মধ্যেই বৌদির বাড়ি থেকে খবর এলো যে মামাতো মাসতুতো খুড়তুতো পিসতুতো বাহিনী মিলিয়ে  ওরা মোট পঁচিশ ভাই বোন। মিনিট দশেক পরে খবর এলো যে বৌদির কিছু বান্ধবীও যোগদান করবেন এই জুতো চুরির মহান কর্মযজ্ঞে , তাই মোটামুটি পঁয়ত্রিশ জনের হিসেবে করে আসাই ভাল। মাসিমা কাগজ পেন নিয়ে হিসেবে করে দাদাকে বললো যে মাথাপিছু দুশো ধরে নিয়ে সাত হাজার ক্যাশ রেডি করে আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে।  সাত হাজার ডলার শুনে দাদা আর্তনাদ করে উঠেছিলকিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই সামলে উঠলো যখন মাসিমা   বোঝালেন ওটা সাত হাজার টাকাসাত হাজার ডলার নয়  সেই মতো আমরা সন্ধ্যাবেলায় রওনা হলাম। 

আমি ভাই হিসেবে খুবই কর্তব্যপরায়ণ। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে সারা সন্ধ্যে জুতো পাহারা দিয়েছিলাম  এতই নিষ্ঠার সঙ্গে পাহারা দিয়েছিলামযে বিয়েতে কন্যা সম্প্রদানের পরেই বৌদির বাবার গর্জন শোনা গেলো  "আমার চটি কে লুকিয়ে রাখলি রে ? আজ অবধি কোনো বিয়েতে মেয়ের বাবার জুতো লুকোনো দেখিনিসিনেমাতেও না ! "

কি আর করাআমি তো দায়িত্ত্ব নিয়ে দাদার চটি সামলে রেখেছিলাম , বাকিরা তাই ভুল করে দাদার শ্বশুরমশাইয়ের চটিজোড়া হাতিয়ে নিয়ে গেছে  ওদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায়না, আসলে দুই জোড়া চটি তো এক দোকান থেকে একসঙ্গেই কেনা, ওখানেও তো ডিসকাউন্ট !!

 

 

তৃতীয় বিয়ে : আরো একটি দশক পেরিয়ে গেছে। বাঙালিদের বিয়ে এখন পুরোদস্তুর BIG INDIAN WEDDING স্টাইল এর সাড়ম্বর বিয়ে।  এক দশক আগেই তো  কুষ্ঠি – ঠাকুরমশাই - পঞ্জিকা ছেড়ে ক্যাটারের - ডেকোরেটর এর মর্জিমতো বিয়ের দিন ঠিক হতো  এই দশক  দেখা গেলো অনুষ্ঠানের  প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া হয় ফটোগ্রাফার এর মর্জি মতো।  ফটো ঠিকমতো ফোকাস না হলে  বারের জায়গায় - বার  মালা বদল করতে হয়। আগুন এর ঔজ্জ্বল্যর সঙ্গে বৌয়ের বেনারসির ঔজ্জ্বল্য যতক্ষণ না মিলছেততক্ষন অবধি বর বৌ আগুনের ধারে পাক খেয়েই যায়অনেকসময়  সাত এর বেশি। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে আবার ক্যাটারের , ডেকোরেটর ইত্যাদিকে দেখাশোনা করার জন্য ইভেন্ট ম্যানেজার থাকেনবাড়ির কোনো আত্মীয়কে সেই দায়িত্ব নিতে হয়নাওনারা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে সেলফি তুলতে থাকেন।

পরের ঘটনা সেইরকম যুগের একটি বিয়ের  আমেরিকা থেকে ছুটিতে দেশে এসেছিসেইসময়ে এক বান্ধবীর বিয়ে  বিয়েবাড়িতে সিঁড়ির মুখে একটা হোঁচট খেয়ে পুরো একটা দরজার ফুলমালা ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলেছি। বেশি কেউ দেখার আগেই ব্যাপারটা সামলে ফেলতে হবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি ডেকোরেটর কে ডেকে আনলাম। ঠিক এই সময়েই বরযাত্রীরা দলবল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনিহঠাৎ পেছন থেকে ক্রূদ্ধ তরুণী কণ্ঠ ভেসে এলো "আপনার কি কোনো আক্কেল নেইদেখছেন যে বর বেচারি অনেক কষ্টে ধুতি সামলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেআর সেখানে আপনি রাস্তা আটকে কি   করছেন?"

নিজের ভুলটা যথা সম্ভব চেপে রাখাই ভালো। তাই আমি একটু আমতা আমতা করেই বললাম "ওই একটু ফুলগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছি

তরুণী আবার গর্জে উঠলেন "আচ্ছা বলুন তোবিয়েতে কোনটা বেশি দরকারফুল দিয়ে সাজানো গেট নাকি বর?"

আমি ওনাদের কে বরযাত্রীদের ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে  নিরীহ ভাবেই বললাম "আমরা তো জানি যে বর  বেশি দরকারিকিন্তু আজকালের বরবৌরা আবার সাজসজ্জার দিকেও খুবই গুরুত্ত্ব দেননইলে ছবি ভালো আসে না"

তরুণী দেখলাম একটু শান্ত হলেন "হ্যা এটা একদম ঠিক কথাই বলেছেনভালো করে সাজান না যত পারেনআমি খালি ভয় পাচ্ছিলাম ঐটুকু   জায়গা দিয়ে বর যেতে পারবে কিনা"

আমি তরুণীকে ভরসা যোগালাম "আমি তো জানতাম যে এই বিয়ের পাত্র নাকি অসাধ্য সাধন করতে পারেন  আর আপনি ভাবছেন এই জায়গা দিতে যাতে পারবেন না "

তরুণী ভ্রূকুটি করলেন "মানেকি বলতে চাইছেন?"

আমি মোক্ষম দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরলাম "আজকাল ভালো ক্যাটারের এর জন্য - মাস আগে বলতে হয়ভালো   বিয়ে বাড়ি পেতে গেলে এক দেড় বছর আগে নাম লেখাতে হয়আর ভালো পাত্রী পাওয়া তো বহু বছরের সাধনার কাজ  কিন্তু শুনেছি উনি নাকি এই সমস্ত কঠিন কাজ এক বছরের মধ্যেই করে ফেলেছেনতাই বলছিলাম " 

দেখলাম কথাটা তরুণীর মনে ধরেছে  "ভালোই তো ডায়ালগবাজি পারেন দেখছিবলে মুচকি হেসে চলে গেলেন। মনে হলো যে উনি নিশ্চই ঠান্ডা হয়েছেন এতক্ষনেতবুও সাবধানের মার্ নেই আমি তাই ওনাকে ঠান্ডা রাখার জন্য আরো দুটো এক্সট্রা আইসক্রিম  দিয়ে এলাম , বিয়েরদিনে বরযাত্রীকে   চটিয়ে কাজ নেই।

পরের কিছু ঘন্টা নির্বিঘ্নেই কাটলো।  বিপত্তি ঘটলো বাসর ঘরে  আমাকে দেখে সেই তরুণী চমকে গেলেন "আপনি বাসরঘরে কি করছেনআপনার কাজ তো হয়ে গেছে নাকি?"

আমিও একটু ঘাবড়ে গেলামআমার কাছে যেটা সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজঅর্থাৎ ভুরিভোজসেটা তো এখুনি   শেষ করেই এসেছি  । তরুণী কি করে সেটা বুঝে গেলেন? আমি একটু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম যে "বাসর ঘরে একটু গল্প গুজব করতে   এলাম সবার সঙ্গে, এই আর কি"

তরুণী  মুচকি হেসে বললেন "আপনি তো খুবই কর্তব্যপরায়ণ ইভেন্ট ম্যানেজার দেখছিআজ অবধি কোনো    ইভেন্ট ম্যানেজার কে বাসরঘর সামলাতে দেখিনি"

আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে জানালাম যে আমার কোনো কিছু ম্যানেজ বা সামলানোর ক্ষমতা খুবই সীমিত , আমি   তাই পাত্রীর বন্ধু হিসেবেই এসেছি 

তরুণী দেখি চমকে গেলেন, "তাহলে স্যুট পড়েন নি কেন?"

সত্যি কথা বলতে আমার আমেরিকা থেকে কলকাতায় ফিরলে সবসময় গরম লাগতোতাই জিন্স টিশার্ট পরেই   এসেছিলাম বিয়েতে , স্বীকার করে ফেললাম "খুবই ভুল হয়ে গেছে জানি স্যুট না পড়াটাআসলে স্যুট পড়লে তো খুব গরম লাগে , তাই "

তরুণীও  একটু লজ্জিত হয়েই স্বীকার করলেন যে আমাকে ইভেন্ট ম্যানেজার ভেবে উনি এতক্ষন কথা বলেছিলেনকিন্তু সঙ্গে এটাও জানাতে ভুললেন না যে আমার পোশাক আশাকের জন্যই এই বিপত্তি। "ইভেন্ট ম্যানেজার সেজে ডায়ালগবাজি ছাড়া কি করা হয়"  উনি জানতে চাইলেন।  আমি সত্যিটাই বললাম "ছোট একটা গ্রাম এর ব্যাঙ্ক  কাজ করি"

তরুণী একটু ক্ষুন্ন স্বরে প্রশ্ন করলেন "মানে আপনি কি টাকা গোনার কাজ করেন?"

আমিও মেনে নিলাম "হ্যাঅনেকটা  ঐধরণের কাজই করি"

তরুণী আমায় আস্বস্ত করলেন যে নিষ্ঠার সঙ্গে করলে সব কাজই সমান ভালো ।  আমিও এককথায় এই সত্যটি  স্বীকার করে নিয়েছিলাম।

এই ঘটনার মাসখানেক পরে সেই তরুণী ফেইসবুক থেকে আমায় খুঁজে বের করে আবার প্রচুর ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন  আমি যে আমেরিকায় থাকিপেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারএইসব না বলে ওনাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলায় উনি যে অত্যন্ত রাগ করেছেন সেটা জানাতে ভুললেন না  আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওনাকে বোঝানোরগ্রাম জিনিষটা যে শুধু ভারতেই থাকেআমেরিকায় থাকে নাএই ধারণা নিয়ে উনি যদি ভুল বোঝেন তো আমি কি করব। আমি তো সত্যি আমেরিকার একটা গ্রামেই চাকরি করি 

তরুণী আরো অভিযোগ করলেন -আমার পেশা নিয়ে মিথ্যে বলা উচিত হয়নিওনার এতে খুবই অভিমান হয়েছে  আমি অবশ্য বারবার ওনাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম যে সত্যি আমার কাজ টাকা গোনাব্যাঙ্কের কোন   ব্রাঞ্চ  কত টাকার লেনদেন হচ্ছেকোন ক্রেডিট কার্ডে কত টাকার কেনাবেচা হচ্ছেএইসব  হিসেব করার সফটওয়্যার প্রোগ্রাম বানাই।  উনি যদি ভাবেন ব্যাঙ্ক কর্মচারী মানেই ক্লার্কতাহলে আমি কি করবোব্যাংকে ক্লার্ক থেকে শুরু করে ম্যানেজারপ্রেসিডেন্ট , সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সবাই কাজ করে একথাও বলেছিলাম  তাও ওনার অভিমান কমেনি 

  

 

উপসংহার : এই তিন দশক ধরে দেখলামকেউ ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে বাঙালি সেজে বিয়ে করেকেউ আবার স্যুট   পড়ে সাহেব সেজে বিয়ে করে।  কখনো তত্ব সাইকেল রিক্সায় যায়কখনো আবার তত্ব outsource হয়ে যায়। যুগের ধর্মই পরিবর্তন , আগামী দশকে হয়তো আরো পরিবর্তন আসবে  হয়তো এরপরে বিয়ে অনলাইন হবেহয়তো শুভদৃষ্টি facetime  হবেহয়তো অতিথিরা জুম্ মিটিং  নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করবে।  যে তিনটি বিয়ের কথা বললামসেই তিন জোড়া দম্পতি আজও সুখে শান্তিতে সংসার করছে।  সুতরাং আশা করা যায় যে আগামী দিনের দম্পতিরাও সুখেই থাকবেনসে বিবাহ অনুষ্ঠানের আড়ম্বর বাড়ুক বা   কমুক যাই হোক না কেন 

বিদেশে বাণী বন্দনা

  প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে , বাঙালিয়ানা আর সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা টা একটু বেশি রকমের হয়ে থাকে। কলকাতায় ...